প্রাণের ও কবিতার টানে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের অবহেলিত গ্রামীণ জনপদে কবিরাজি পেশা থেকে কবিতা লিখে লিখনীর শৈল্পিক ছোঁয়ায় অন্যতম হয়ে উঠেছেন রাজশাহীর তানোর পৌর সদরের কুঠিপাড়া গ্রামের কবি রেজাউল ইসলাম। তাঁর কবিতায় বোধ, বিশ্বাস, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশমাতৃকা, ধর্ম, দর্শন যেমন প্রাধান্য পায়, তেমনি বরেন্দ্র ভূমির সমকালীন প্রেক্ষাপটে ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁর শিল্পিত হাতের আঁচড়ে হয়ে ওঠে জীবন্ত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বাগমারা উপজেলার শান্তিপাড়া গ্রামে ১৯৫২ সালের (বাংলা ১৩৪৮ সালের ১১ অগ্রাহায়ণ) কবি রেজাউল ইসলাম জম্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শমসের আলী ও মাতার নাম পদ্ম বিবি। তিনি কালীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি, ১৯৬৬ সালে চকগোবিন্দ হাই স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি ও ১৯৭২ সালে হাটগাঙ্গোপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে তানোর আব্দুল করিম সরকার কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে নিজ জন্মস্থান ছেড়ে ১৯৮৮ সালে তানোর উপজেলার পৌর সদরের কুঠিপাড়া গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
জানা যায়, ছাত্র জীবন থেকে কবি রেজাউলের লেখালেখি শুরু করে এবং ওই সময় স্কুল জীবনেই লেখক হিসেবে এলাকায় তার ব্যাপক সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ১৯৮৬ সালে ‘প্রাক্ষিক গ্রামবাঙলা’ পত্রিকার সহসম্পাদক, ২০০০ সালে ‘ধানসিড়ি’ পত্রিকার প্রচার সম্পাদক ও ২০০২ সালে প্রান্তর পত্রিকার সহসম্পাদকের দায়িত্বপালন করে।

এছাড়াও ২০০৩ সালে তার সম্পাদনায় রুপসী বিলকুমারীর কান্না, ভোরের শিশির, ভোরের গান, পলাশ আজও কাদে ও রক্তেরাঙা ফিলিস্তিনসহ অসংখ্য ছোট-ছোট অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরে তাঁর রচিত রক্তে রাঙ্গা ফিনিস্তিন প্রবন্ধ অঙ্কুর পত্রিকায় ইংরেজীতে অনূদিত হয়। তবে ‘হরিবাসর’ নামক সনাতন ধর্মলম্বীদের একটি জনপ্রিয় কবিতা লেখার জন্য “একে সরকার কলেজের” সাবেক অধ্যক্ষ নারায়ন চন্দ্র বিশ্বাস কবি রেজাউল ইসলামকে ‘ধ্রুবতারা’ উপাধিতে ভূষিত করে। বর্তমানে তিনি সাহিত্যিক ত্রৈমাসিক ‘বিলকুমারী’ পত্রিকা প্রকাশনায় নিরালসভাবে কাজ করছে। স্থানীয়দের দাবী, আর্থিক দৈন্যদশার কারণে মেধাবী এই মানুষটি তার মেধার বিকাশ তেমন একটা জনপ্রিয়ভাবে ঘটাতে পারেননি, এমনকি বাঙ্গালি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ বা সম্মানী কোনটাই তার কপালে জোটেনি। আবার সরকারি, বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এগিয়ে আসেনি তাকে সহায়তা করতে।
জানা গেছে, ৬৫ বছর বয়সী কবি রেজাউলের একমাত্র আয়ের উৎস কবিরাজি। আর কবিরাজি করে যা আয় হয় তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি কবিতার বই প্রকাশ করেন। কিন্তু কোনো প্রকাশনী সংস্থা এগিয়ে না আসায় তিনি এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্য এসব বই সরবরাহ করেন।

ইতিমধ্যে নিজ উদ্যেগে কবি রেজাউল ইসলামের প্রায় দেড় শতাধিক ছোট গল্প ও কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আগুনের গান, ফোটা ফুল নিশি, স্বর্ণ রেখা, ভোরের শিশির, কবরের কান্না, রেজাউল সংগীত অন্যতম। তিনি ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে এখানো সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। তবে বর্তমানে অর্থাভাবে কবি তার লেখা প্রায় ১০টি গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারছেন না বলে জানা যায়।

উপজেলার সাহিত্য অনুরাগীদের অভিমত, অবহেলিত কবি রেজাউল তাঁর কবিতায় লিখনীর মধ্যে নিজের পরিমিত আবেগ-অনুভূতি, আত্মজিজ্ঞাসা, ধর্ম, দর্শন, সাংঘর্ষিক সত্তার কল্পনাশক্তির শিল্পিত প্রকাশ ছবির মতো কথা কয়, পাঠককে দোলায় ছন্দের দোলায় আর এ কারণেই তাঁর প্রতিটি কবিতা দিনদিন হয়ে ওঠছে কবিতা পাগল পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হয়ে।
তবে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কবি রেজাউল বরেন্দ্রের পোড়া মাটি থেকেই দেশের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাইতো সাহিত্য সচেতন ও শিক্ষানুরাগীরা অবহেলিত এ কবিকে সহায়তা করতে এলাকার ও সমাজের বিত্তশীলদের এগিয়ে আসার আহবান জানান তারা।

মিজানুর রহমান, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি