* উদ্ধোধনের অভাবে চালু হচ্ছেনা ৫০ শয্যার হাসপাতাল
* ১২ ডাক্তার সহ ৪৩ পদ শূন্য
* চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত ৪ লাখ মানুষ

চিকিৎসকের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে এখন রাজশাহীর তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেহাল দশা। এতে উপজেলার দুই পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষেরা চিকিৎসাসেবার একমাত্র সরকারি এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বছরের পর বছর। সরেজমিনে গিয়ে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে উপজেলার আমশো মোড়স্থ প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি এখন নিজেই রোগী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট চিকিৎসকের পদ ১৭টি। যার ১২টি চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন যাবৎ। এরমধ্যে আবার কর্মরত চিকিৎসকদের ৮০ ভাগ থাকেন অনুপস্থিত। এছাড়াও অন্যান্য কর্মকর্তা, নার্স, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর ৩১টি পদ শূন্য রয়েছে। সবমিলিয়ে ১২ জন ডাক্তার সহ ৪৩টি পদ শূন্য রয়েছে। শুধু জনবল সংকটই নয়, হাসপাতালটিতে রয়েছে আরও সমস্যা। এর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইসমত আরা দাপ্তরিক ও বিভিন্ন কাজে প্রায় দিনই ব্যস্ত থাকেন। উপকরণ থাকার পরেও সময়মতো প্যাথলজি পরীক্ষা হয় না আর ১টি এ্যাম্বুলেন্স থাকলেও স্থানীয় মাইকো মালিকদের কাছে অনেকটা অসহায়। এখানে এক্স-রে মেশিন, ইসিজি মেশিন, জেনারেটর, ক্যালোরিমিটার ও মাইক্রোস্কোপ দীর্ঘদিন না চালিয়ে সেগুলোর অচল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু আধুনিক মানের চিকিৎসা সামগ্রী, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, কারিগরী উপকরণের অভাব ও ৩১ শয্যা হাসপাতাল থেকে ৫০ শয্যার হাসপাতাল ভবনের অবকাঠামো নির্মাণের পরও শুধুমাত্র উদ্বোধনের অভাবে চালু হচ্ছে না ৫০ শয্যার হাসপাতালটি।

আবার এখানে ডাক্তারদের পরিবর্তে মূলত চিকিৎসা দেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসাররা (মেডিক্যাল এসিসটেন্ট)। কিন্তু দূর-দূরত্ব থেকে আগত রোগীরা তাদের দেয়া চিকিৎসায় তুষ্ট হতে পারছেন না। শল্য চিকিৎসক (সার্জিক্যাল) এবং অ্যানেসথেসিয়া (অচেতন বিশেষজ্ঞ) চিকিৎসক না থাকায় অস্ত্রোপচারও (অপারেশন) এখানে হয় না। তার মধ্যে হাসপাতালের প্রধানসহ কোন ডাক্তার সরকারীবিধি মোতাবেক কোয়াটার বা ক্যাম্পাসে থাকেন না। সবাই বাইরে থেকে আসা-যাওয়া করেন। এছাড়া এখানে আরএমওর পদসহ সার্জারী, মেডিসিন ও অ্যানাস্থেসিয়া ডাক্তারের পদ দীর্ঘদিন শূন্য রয়েছে। শুধু তাই নয় এ হাসপাতালে যে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন তারাও সপ্তাহে ২/৩ দিন অফিস করেন। বাকি দিনগুলোতে আর্থিক সুবিধায় স্থানীয়ভাবে বা অনত্র চেম্বার খুলে এবং ক্লিনিকে রোগী দেখে থাকেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।
এছাড়াও এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে পুরুষ ও নারী-শিশু ওয়ার্ড দুটিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতি থাকলেও তার বেশির ভাগ ফ্যান ঘোরে না এবং বাল্ব জ্বলে না। বিদ্যুত চলে গেলে ওয়ার্ডসহ পুরো হাসপাতাল চত্বরে নেমে আসে অন্ধকার। আর এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি থাকা রোগীদের মাঝে নি¤œমানের খাবার পরিবেশন করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তাছাড়াও হাসপাতালটির জন্য বরাদ্দকৃত যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন যাবৎ। হাসপাতালের চারিদিকে ব্রিচিং পাউডার ছিটানোর কথা থাকলেও তা মোটেও করা হয় না। হাসপাতালের বাইরের এলাকায় সন্ধ্যার পরেই মাদকসেবীদের আনাগোনা লক্ষ্য করার মতো। নিরাপত্তা বিষয়েও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।

সন্ধ্যার পর বীভৎস গন্ধের সাথে মাদকের গন্ধও পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালটির দক্ষিণ ও পশ্চিম পার্শ্বের সদ্য নির্মাণকৃত সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে হাসপাতালটির ভিতর দিয়েই প্রতিনিয়ত ছোট-বড় সব ধরনের যান চলাচল করছে এমনকি রোগীরা সরকারী ঔষধ পান না বলে অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ। আবার হাসপাতালটিতে স্থানীয় প্রভাবশালী ও বিভিন্ন নামে-বেনামে ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দৌরাতœ্য চরমে। ফলে চরম অব্যবস্থাপনায় ৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী হয়ে গেছেন। হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, এখানে কর্মরত কোনো চিকিৎসকই হাসপাতালের বাসায় থাকেন না। তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এভাবেই চলছেন। এছাড়া এ উপজেলায় গ্রাম পর্যায়ে মোট ১৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু থাকলেও অধিকাংশ ক্লিনিক দুপুরের পরে আর চালু থাকে না। যদিও ক্লিনিকগুলো সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখার নিয়ম রয়েছে। ডাক্তার সংকট, আবাসিক চিকিৎসক না থাকা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে সাধারণ হাজার হাজার মানুষ এসব কেন্দ্র গুলো থেকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এদিকে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে মুন্ডুমালা, তালন্দ, কলমা, সরনজাই ও কামারগাঁ ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসারের পদও শূন্য রয়েছে বলে জানা গেছে।স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বহির্বিভাগে আগত রোগীদের বিভিন্ন রোগের জন্য প্রায় একই ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এ ব্যাপারে শরিফুল ইসলাম নামের একজন রোগী বলেন, ‘যেই অসুখ নিয়াই হাসপাতালে আসি না কেন, কপালে জোটে শুধু প্যারাসিটামল আর এন্টাসিড।’ বোধগম্য কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগী জানান, এখানে ১১ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু কোন ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে না। নার্স ও আয়াদের অবহেলা অব্যস্থাপনায় রাগ ও অনুরাগে রোগ ভাল হবার বদলে মানষিক রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এক কথায় এখানকার এত খারাপ অবস্থা বলে শেষ করার মতো নয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) ইসমত আরা’র সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সীমিত লোকবল দিয়ে পুরো উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা সুষ্ঠুভাবে প্রদান করা কঠিন। তার পরও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

তবে এ হাসপাতালে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও তা এখনও চালু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধনের অভাবে তা চালু করা যায়নি। তবে অতিশ্রিঘই তা চালু হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।এনিয়ে রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. সনজিত কুমার সাহার সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহা: শওকাত আলী প্রতিবেদকে বলেন, ‘তানোর উপজেলাবাসীর স্বাস্থ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে যা করা দরকার, পর্যায়ক্রমে তা-ই করা হবে। এ ব্যাপারে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।’#

মিজানুর রহমান, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি