আলমগীর কবীর হৃদয়-এর ‘প্রত্যাশিত মরীচিকা’ মানব-মানবীর প্রেমময় একান্ত জীবনতৃষ্ণার না-ফুরানো নৈতিক তীব্র আকাক্সক্ষার কাব্য

আলমগীর কবীর হৃদয় যেন অস্থিমজ্জায় একজন আকণ্ঠ রোমান্টিক কবি, তিনি যেন জন্ম-জন্মান্তরেরও প্রেমের কবি; যেহেতু তার লেখনীতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেÑ সর্বদাই যেন তিনি চিরচেনা নিসর্গ আর মানব-মানবীতে নিমজ্জিত হয়ে এক অদ্ভুত স্বপ্নময় হতবিহ্বলতার দৃশাবলী এঁকে থাকেন তার কবিতার ক্যানভাসে। তার কবিতার ভেতরে সঞ্চারিত সাতরঙা রঙধনু যা সহজেই পাঠকের চেতনাকে রাঙিয়ে তোলে ভালোবাসার মোহবিষ্ট অনুভবে। এজন্য হয়তো অনেকেই বলে থাকেন, আধুনিক বাংলা কবিতার হাজার বছরের পথ পরিক্রমার যে-তাৎপর্যপূর্ণ গৌরব, কবি আলমগীর কবীর হৃদয়-এর কাব্যগ্রন্থ যেন সেই ক্রমবিবর্তনেরই একটি গ্রহনযোগ্য শানিত অধ্যায়।

তার রচিত শুদ্ধ প্রণয়ের মোহনীয় কবিতা থেকে তিনি অচরিতার্থ কামের সবগুলি প্রলোভনকে নির্দয়ভাবে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তিগত সুষমা-সৌন্দর্য-অনুভব ও ভাববাদের সংমিশ্ররণে জীবনধর্মের এক অভিন্ন সমান্তরাল রেখাচিত্র অঙ্কিত করতে প্রায় ওস্তাদ। শিল্পের প্রতি ব্যক্তিগত গভীর দায়বদ্ধতা থেকে কবি আলমগীর কবীর হৃদয় মানব-মানবীর হৃদয়ের অনুচ্চ আশা-আকাক্সক্ষা, আবেগ, প্রেম-ভালোবাসা, চলতি আধুনিকতা, নিত্যদিনের উদ্ভুত সমস্যা, দেশ-রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সামাজিক পরিবর্তন-বিবর্তন তথা সর্বোপরি জীবনের এবং তার বৈরি বিবমীষার ছবিগুলি ভালোবাসার সাথে এঁকে থাকেন স্নিগ্ধতার অপরিমেয় সৌন্দর্যেÑ আর এই পরিশোধিত স্বর্গীয় স্নিগ্ধতায়ই সাক্ষ্য দেয় যে, তার এই কাব্যগ্রন্থে প্রেমবোধের আত্মিক তীব্রতা ও কবিপ্রতিভার জটিল এক রহস্যময়তার তল থেকে তিনি অন্তরগত অনুভবের প্রত্যয়কে সাদামাটা শব্দের মায়াজালে রূপময় এবং ধ্বনিময় করে তুলে আনতে সক্ষম বিস্ময়কর এক শিল্পসংগঠনের মধ্যে দিয়ে। কেননা এই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে মানব-মানবীর প্রেমময় একান্ত জীবনতৃষ্ণার না-ফুরানো স্বর্গীয় তীব্র আকাক্সক্ষা: যেমনÑ মনে রেখো সব আলো একা নয়/ প্রভাতের প্রত্যাশায় যখন/ রাতের সব আয়োজন সমাপ্ত/ দেখিবে বাতাবি লেবুর ঘ্রান, বৃক্ষের দয়িতা…’এতেই কী বিদগ্ধ পাঠকের বোধের মাত্রা পরিস্কার হয় না যে, হৃদয়ের এই স্বপ্নময় পঙক্তিমালা অন্তর-অনুভবের দ্বন্দ্বমুখর জটিল এক রহস্যময়তার তল থেকে উঠে আসা এক সকরুণ প্রেমময় সংগীত।

বিশ্ব-মানসে প্রেমভাবনার রৈখিকতার কোনো শেষ নেই। বোধের বিচিত্র আলো-আধার, বিচিত্র রঙ-রেখা, মাত্রা-মাত্রান্তর প্রেমবোধকে নানাভাবে বৈশিষ্ট্য দান করে আর যেটা কখনোই ব্যাখ্যাতীত নয়। বরং অনুভবের গভীর ও গোপন এক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সেই বোধ অনির্দিষ্ট তৃষ্ণার আয়োজন করেÑ এই দর্শন খণ্ডিত হয় না যখন চোখে পড়ে: আজ যখন তুমি এলে Ñ বালিকা ডাহুক/ আমার হৃদমন্দিরে উচ্ছ্বাসের ঝিলিক উছলে উঠেছিল/ খরস্রোতা নদী দু’কুল ছাপিয়ে আপনার পথ হারালো…।
সহজ, নির্মল প্রাণাবেগের স্বাচ্ছন্দময় উপস্থিতিতে কাব্যসমূহ উচ্ছ্বল অর্থাৎ যেমন কাব্যভাষে তেমনি প্রকরণিক সারল্যে ঋদ্ধ পঙক্তিগুলো জীবনরহস্যের গভীর ভাষ্যে বৈশিষ্ট চিহ্নিত। এবং কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম ‘প্রত্যাশিত মরীচিকা’-য় স্বয়ং কবির তাবৎ হতাশা-নৈরাশ্য একটি স্নিগ্ধ-কারুণ্যে ভরে উঠেছে। বিদগ্ধ পাঠকমহল কবি আলমগীর কবীর হৃদয়কে নতুন আঙ্গিকে নতুনভাবে খুঁজে পাবেন ‘প্রত্যাশিত মরীচিকা’-র, পাতায়-পাতায় এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কেননা এই কাব্যগ্রন্থের প্রেমাশ্রয়ী কবিতাসমূহের সঙ্গে মন ও মননের এক ইতিবাচক জীবনবার্তা বয়ে এনেছে। উপযুক্ত কবিতার ব্যঞ্জনা একজন ব্যক্তি-মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আনন্দ-বেদনার দিগন্তকে আরো বিস্তৃত করে দেয়। মানবীয় সংবেদশীলতা উড়ো খবরের মতো আভাসিত হয় এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায়। এবং একই সাথে কবিতার বর্ণনায়, নির্মানশৈলীতে ও ধ্বনিবিন্যাসে-বিলাসে জীবকে উল্টেপাল্টে দেখারও যেন এক বিচিত্র আখ্যানÑ প্রত্যাশিত মরীচিকা। যেমন কাব্যভাষ্যে তেমনি প্রাকরণিক সারল্যে ঋদ্ধ পঙক্তিগুলো কখনো বা ব্যক্তিক প্রেমের সংহত উপস্থাপনে কখনো সে জীবনরহস্যের গভীর ভাষ্যে বৈশিষ্ট চিহ্নিত। উদাহরণ: শূন্যতায় আসন গেড়ে ক্রুশবিদ্ধ সময়ের ত্রিশূল হাতে/ যে আকাশকে ভালোবেসে তুমি তার বুকে/ দিবা কিবা রাত্রিতে মেঘমালা হয়ে ভাসতে… (বিশ্বাসের পালক) এই গোপন ভাবনায় কবির আত্মোবেগের উদ্বেলতা ঝলমল করে উঠেছে। এর পেছেনের কার্যকারণ সূত্র স্নিগ্ধতার অপরিমেয় সৌন্দর্য-আধার কবির মানস-প্রণয়ী; কিন্তু সে অধরা স্পর্শহীন: ফলত সৌন্দর্যের উপেক্ষিত নৈরাশ্যে উদভ্রান্ত কবি-অন্তর।

কবি আলমগীর কবীর হৃদয়-এর বিশেষ বৈশিষ্ট তিনি কবিতার দয়িতাকে উদ্দেশ্য করে আবার কখনো বা নিজের উদ্দেশ্যেই রুপকথা-উপকথার আদলে ব্যক্তি-ইতিহাস-অস্তিত্ব বা অস্তিহীনতাকে উন্মোচন করতে চান সত্যভাষণ ও সত্য আবিষ্কাকারক হিসাবে। তার কবিতায় নিস্তরঙ্গ জীবনেও বিরতি দিয়ে পুর্নবয়ান হয়ে ফিরে যায় অতীতচারণের ভাষ্য। যে জীবনবাক্যে ছিল শুধু প্রবাহমানতা সেখানে সময়ের ব্যবধান মাত্র কমা অথবা সেমিকমা: কামনা-বাসনাযুক্ত উত্তেজক চেতনা থাকা সত্ত্বেও কবি প্রসন্নচিত্তে শুধু প্রেয়সীর রেশমি চুলের সৌন্দয়ে উন্মুখ: তোর কোমল চুলের নরম ঠিকানা/ তোর হিমশীতলের ঊষ্ণতা/ আমার বুকের পুরো জমিনটা..(তুই আর আমি)। রোমান্টিকতা তার কবিতায় এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, আরোপিত হয়ে নয়। প্রণয়ী ও প্রেমের চিরকালীন সত্য-সুন্দর, সৌন্দর্যরূপ এই রোমান্টিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে প্রেমিক কবিহৃদয়কে ঐশ্বর্যময় করেছে তার কবিতায়। কবিচিত্তের অচরিতার্থ সৌন্দর্য-আকুলতাই এই কাব্যগ্রন্থের প্রধান নিয়ামক। নৈঃসঙ্গের ভরাডুবি কবির নস্টালজিক শোভন চৈতন্যের পরিচয় উৎকৃর্ণ হয়ে উঠেছে এই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায়।

জীবনকে কীভাবে বুঝতে হয়, কীভাবে তাকে পৌঁষ মানাতে হয় এবং জীবনের উপর কীরুপে আলো-ছায়া ফেলতে হয় সর্বোপুরি জীবনের নিগূঢ় রহস্যকে কী উপায়ে অনুসন্ধান করতে হয়, জীবনছবি চিত্রায়ণের শিল্পিত কলাকৌশল বা কেমন আর এই সবকিছুর সমন্বয়ে কী করে কবিতা হয়ে ওঠে, যেন সেই হয়ে ওঠার শিল্পই হচ্ছে কবি আলমগীর কবীর হৃদয়-এর প্রত্যাশিত মরীচিকা। কাজেই বলা যায়Ñ কবি আলমগীর কবীর হৃদয়-এর শিল্প-অস্তিত্বের গভীর চেতনা সঞ্চয় করে নিয়েছে দেশ-কাল-সমাজ ও পারিবারিক তথ্য-উপাত্ত এবং আপন জীবনবৃত্তের পূর্ণ অববয়। ব্যক্তিচৈতন্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কালিক পটভূমিকে দূরে ঠেলে রাখার কোনো উপায় নেই। তাই কালেরখেয়ায় ভাসমান দোদুল্যমান মানবের অস্তিত্বসূত্র নির্ধারণে কালের অভীপ্সা অনিবার্য। কবি আলমগীর কবীর হৃদয় শক্তপোক্তভাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন কালের উপত্যাকায় দাঁড়িয়ে। ২০১৭ বইমেলা উপলক্ষে বহুল আলোচিত ও সুখ্যাতিমান উত্তরণ প্রকাশনা থেকে ঝকঝকে মুদ্রণে ছাপা হয়েছে সৌন্দর্যবর্ধক এবং টেকসই শ্বেতশুভ্র অপসেট কাগজে। নান্দনিক এই কাব্যগ্রন্থের নয়নাভিরাম প্রচ্ছদ এঁকেছেন অরুপ মান্দী। পাবনার বইমেলার সকল স্টলে এবং ঢাকা বইমেলার ২৬৫ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। মূল্য: ১২০ টাকা। সর্বোপুরিভাবে গ্রন্থটি পাঠশেষে পাঠকের সংগ্রহশালাকে সম্বৃব্ধ করবে। এমনকি নির্দ্ধিয়ায় এই কাব্যগ্রন্ধটি প্রিয়জনের জন্য উত্তম উপহারও হতে পারে। বইটি‘র সম্পর্কে চমৎকার ভাবে লিখেছেন প্রখ্যাত কথা শিল্পী, লেখক, কবি সাইদ হাসান দারা।

কামাল সিদ্দিকী, পাবনা।