পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে প্রথম দিন। মুঘল স¤্রাট আকবার বাংলা সাল প্রবর্তন করেন। যার মূলে ছিলো ফসল উঠার উপরে। এ সময় প্রজারা খাজনা দিতে কাছারি বাড়ি অথবা জমিদার বাড়ি যেত।জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টি পানসহ নানা উপাদেয় দিয়ে আপ্যায়িত করত।যা পুণ্যাহ অনুষ্ঠান নামে পরিচিত ছিলো।অথবা নওরোজ নামেও ডাকা হত। ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলত,এখনো হালখাতা অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখে।ঘর বাড়ি দোকান প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করত।এভাবে কালক্রমে বিবর্তনের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়।এখন এ উপলক্ষে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান হয়। মুখোশ পড়ে বাঙালির ঐতিয্য বহন করে এমন কিছু নিয়ে র‌্যালিতে যায়। আর শহরের সাথে গ্রামের মানুষেরা মেলার আয়োজন করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কার্যকাল ব্যাপি বসে মেলা। যা কখনো তিন দিন কখনো সপ্তাহ পক্ষকাল এমনকি মাসব্যাপিও স্থায়ী হয়।বাঙালি পান্তা মরিচ ও ইলিশ ভাজি খেয়ে তৃপ্ত হয়। বৈশাখের এ সময় প্রকৃতিতে থাকে রুদ্ধভাব।উষ্ণ আবহাওয়া , থেকে থেকে কখনো ঈশান কোণে মেঘ করে প্রলংকারী ঝড় উঠে কৃষকের বুকে ভয় ধরায়। হাতে হাতে তালের পাখা দেখা যায়।দস্যি ছেলেরা ঝিনুক/ছোরা হাতে আম তলায় ঘুর ঘুর করে আমের গুটির আশায়।প্রখর রোদে খাল বিল শুকিয়ে ফেটে চৌচিড় হয়।মধুমাস জোষ্ঠ্যের জন্য আম কাঁঠাল লিচু জাম ডালে ডালে পরিপক্কতার দিকে এগিয়ে যায়।নববর্ষে বাঙালি নবচেতনায় এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়। জরা জীর্নতা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায়।উপমা রূপকসহ নানা অলংকারে বৈশাখের এমন দৃশ্য কবি পদ্মনাভ অধিকারীর “শুচি হোক” শিরোনামের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়

“তাপদগ্ধ দিন ,ঈশান মেঘের মতো
মেঘকুমারী ঐন্দ্রয়জালিকমাদুরী ছড়িয়ে
চোখ ধাঁধাতে মেল্লে রঙ বাহারি ডানা!

গাছে গাছেকত যতেœ ধরেছে দুধ সাদা ফুল…।

“আসলে সে তো ঝুমকো লতার দুল,
অকারণে যাকে ভুল করে ভেবেছি ফুল!
আর মনের বনের সে আবহে- ইচ্ছে করেছে
উড়াল দিতে; দুরন্ত হাওয়ার সাথে উড়ে উড়ে
ঘুরে ঘুরে মধু নিতে Ñ যুগলবন্দি গাইতে!
বোশেখের প্রথম এক পশলা – ঝরঝর …
তাতে আসুক না উড়াতে ঢেউ, গর্জে বর্ষুক,
নতুন সে স্রোত, হোক না আপন
ছন্দে পাগল পারা …। আর সে জলেই
শুচি হোক -হোক শীতল আমাদের এ ধরা…।”

জীবন্ত চিত্র অঙ্কনে সিদ্ধহস্ত কবি।বাংলাদেশে বৈশাখ মাস আসে উষ্ণতা নিয়ে ।তা মাঝে মাঝে চরম রূপে আবর্তিত হয়।বৈশাখী রোদে ঝলসে আমের গুটি কাঠাঁলের কুসি ঝরে পড়ে।বিরূপ প্রকৃতি থেকে বাঁচতে মানুষ আশ্রয় খোঁজে একটু শীতল পরশের।কখনো গাছতলায় কখনো মেঝের শীতল পাটিতে।যা বাঙলার নারীরা অতি যতেœ মনের মাধুরী মিশিয়ে তেরী করে।তা স্বপ্ন মিশে থাকে।গ্রামের মানুষের হাতে নকসি তাল পাখা শোভা পায়।এমন দুপুরে কোনো এক নারী পোষা বিড়াল বুকের কাছে নিয়ে কি জানি ভাবচ্ছে।হয়তো সংসার জীবনের না পাওয়া কোনো আর্তনাদ যা কাউকে বলা যায় না ।অথবা সে শুধু ভার বইয়ে চলছে কিন্তু তার চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য নেই।তারা ঝিনুকের প্রদাহের সৃষ্টি মুক্তার মতো বুকের গহীনে অব্যক্ত ব্যথা যতেœ লুকিয়ে রাখতে পারঙ্গম। এতসব সত্বেও তারা বেণী করে চুল বাধতে পারে,পারে খোঁপায় বনফুল গুঁজতে,প্রেমিকা হয়ে স্বপ্ন বোনে ,সারাদিন সংসারে নড়ে নড়ে নিপুন ছন্দে সাংসারিক চাকা সচল রাখে।এই সব শৈল্পিক দৃশ্য গ্রাম বাংলা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না।তাই তো জীবনানন্দ দাশ বলতে পেরেছিলেন –

“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি , তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর:” (বাংলার মুখ আমি)
অপূর্ব সে দৃশ্য ।জন্ম -জম্মান্তর দেখেও তৃপ্তি মিটবে না।বাংলার এই অহরহ সৌন্দর্যময় চিত্র আমাদের আবেশে জড়িয়ে রাখে। এমন সৌন্দর্যে পরিপুষ্ঠ মনোহরী দৃশ্য দেখি কবি পদ্মনাভ অধিকারীর “দেখেছি তারে” কবিতার পঙতিতে

“ নিদাঘের দিন ,মাঝ দুপুর। সূর্যটা উপুড় হয়ে
ছড়িয়ে দিচ্ছে আগুন,যে আগুনে
ঝলসে যাচ্ছে ডালে ডালে ,থোকায় থোকায়
কৃষ্ণচ’ড়া,আমের গুটিÑকাঁঠালের কুসি!
সে আবহে এক উন্নত বক্ষা রমণী,
বুক যার আধ খোলা- আধ আবরণে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মেঝেই – পাটিতে,
হাতে ধরা কারুকাজ করা তালের পাখা
বুকের কাছে রয়েছে যার পোষা বিড়াল…।

যে দৃশ্য দেখে সূর্যের মুখেও হাসি ধরে না,
কে রমণী;তারে না জানি-না জানি তার নাম!
লালপাড়- নীল জমিনের শাড়ী পরণে,
দীঘল এলো কেশী সে অনামিকা:
শিল্পকলা শৈলীতে ভরপুর সৌষ্ঠব,
বাঙলার রমণ প্রতিনিধি জেনেছি যারে,
দেখেছি পলকহীন তারে,কি অপরূপ
দৃশ্য মাঝ দুপুরে…..।”

রবীন্দ্রনাথ আধুনিক প্রাকৃতিক ধ্বংসকারী যন্ত্র সভ্যতার প্রতি বিদ্বেষে লিখেছিলেন – “ দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য নাও এ নগর”। আজ প্রকৃতি যখন বিরূপ আকার ধারণ করেছে মানুষ হাপিয়ে উঠছে ,শিকার হচ্ছে বিরূপ প্রকৃতির করাল হিংস্যাত্বক নখর থাবায় ,সতেজ বাতাসের অভাবে ফ্রেশ নিঃশ্বাস নিতে পারছি না,নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে ,নদীর পানি দূষিত -দখল হচ্ছে ,প্রাকৃতিক সম্পদ -পশু -পাখি ধ্বংসের মুখোমুখি তখন আমরা বুঝতে তখন আমরাবুঝতে পাচ্ছি প্রাকৃতিক সম্পাদের গুরুত্ব।তাই নতুন বছরের শুরুতে বৈশাখ মাসে প্রাকৃতিক বান্ধব পরিবেশ গড়ার শপথ নিতে হবে আমাদের আগামী প্রজম্মর সুখি সমৃদ্ধ জীবনের কথা চিন্তা করে।মানব দরদী কবি পদ্মনাভ অধিকারী নতুন বছরের শুরুতে সেই কামনা করেছেন এভাবে

“শরীর জুড়াবে!কোথায় পাচ্ছ বনের সেই শীতল হাওয়া?
সে কারণেই মেঘের কাছে প্রাণ জুড়াতে জলটা চাওয়া।
প্রার্থনা তাই বোশেখের কাছে উদ্বোধনিতে এইটুকু
যেন তার জলহাওয়ার মিষ্টি ছোঁয়ায় ভাল থাকে খোকা খুকু।” ( দূর হোক)

বৈশাখ মাসে প্রকৃতি বিরূপে উষ্ণ হয়। জনজীবনসহ সমস্ত প্রকৃতি যেনো তপ্ত রোদ আর উষ্ণ আবহাওয়ায় ত্রাহি আকার ধারণ করে।হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ জমে ! একটু পরে হয়ত কাল বৈশাখী ঝড়ে ভিজে যাবে প্রকৃতি । সে জলধারা ফিরিয়ে আনবে স্বস্তি । আনেও তাই কিন্তু কাল বেশাখী ঝড় মাঝে মাঝে ব্যাপক ধ্বাংসাতœক তা-বলীলাও চালায়।তথাপি আমরা বাঁচার অনুপ্রেরণা পাই।নতুন ফসলের জন্য বীজ বোনার অনুপ্রেরণা পাই।জনমন প্রশান্তি লাভ করে। সেই স্বস্তির অনুভূতি ও চমৎকার উপস্থাপনা নিচে উল্লেখিত পদ্মনাভের কবিতায় পাই –

“বোশেখ মাসের তপিশ ত্রাসে -ওষ্ঠাগত প্রাণ,
অঝর ধারায় ভেজার আশে
প্রাণ করে আনচান।

প্রাণের সেই আকুতি শুনে
ঈশান কোণে মেঘ করে -মেঘ নামলে,
জুড়ায় ধরার যত তপাহত প্রাণ…। ” (তপিশ ত্রাসে)
অথবা,
“এমন সময় বর্ণালি প্রজাপ্রতি মেঘ ঘুরে ঘুরে,
উড়ে উড়ে এলেÑখরতাপে পোড়া আঙিনায়!
ঠিক তখনি,কাল বোশাখি ঝড় জলের তা-বে,
এলোমেলো কোরেদিলো মনের মেলাÑ ভ্যালা Ñবসত।
ভাসিয়েনিলো জনপদ-আপদ-শ্বাপদ,
কোরলো শীতল যন্ত্রণা দগ্ধ মানব জমিন!
শত কষ্টেও আহ্ , কী প্রশান্তি, – সফেদ ফুলঝুরি
ঝরিয়ে – ভিজিয়ে দিলো – গাঁ- নগর-বন্দর!
নতুন ফসল ফোলবে আবার!আহ্ মনের
বরষায় ভিজতে কে না চায় এমন সময়…।” (মনের বরষায়)

শুরু করে নব চেতনায় । যতসব পুরাতন জরাজীর্ণতা মুছে ফেলে এগিয়ে যায় সমৃদ্ধির পথে।বাঙালি নতুন বছরকে বরণ করে একটি সার্বজনীন উৎসবের মাধ্যমে।কিন্তু ১৪২২ বঙ্গাব্দে প্রাচ্যের অক্যফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে যৌন হয়রানীর মত ঘৃণ্য অপরাধ সংগঠিত হয় । তাও আবার শাসক দলের ছাত্র সংগঠন দ্বারা।কিন্তু নেতৃবৃন্দের কথার বহর থাকে “ দুষ্ট”র মধ্যে সীমাবদ্ধ । তাদের ভ’মিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই যদি হয় মানুষ তৈরীর কারিগর -কারখানার অবস্থা তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায়! দুঃচিন্তায় ফেলে দেয়।।এমনিতে দেশে অরজকতা চলছে Ñ ক্ষমতা দখলের জন্য হীন চক্রান্ত,যুদ্ধাপরাধী- জঙ্গিদের উত্থান, অবৈধ দখল (এমন কি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও),সন্ত্রাস- চাঁদাবাজি ,বিদেশী শক্তির আগ্রাসন ,অতিরুক্ত জনসংখ্যার ফান্ডামেন্টাল চাহিদা পূরণে হিমসিম গদিসীন, এ সব নানাবিধ কুপ্রথা Ñ অনাচারে দেশ ধর্ষিত নারীর মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।তারা সর্বোচ্চ বিচালয়কেও তোয়াক্কা না করে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।দেশের এ হীন অবস্থার জন্য দায়ী কে বা কারা? এ প্রশ্ন আজ জাতির বিবেকের কাছে।সমকালীন বাংলাদেশের পরিপুর্ণ চিত্র পদ্মনাভ অধিকারীর সাহসী উচ্চারণে পাই । এই চিত্রকার কবি শব্দের অংকন দেখি নিচে উল্লেখিত কবিতায়।

“প্রীতিপূর্ণ প্রাণে করি
শুভ প্রাণের আহ্বান,
জীর্ণ মলীনতা ভেসে যাক…

পৈত্রিক ভিটে হচ্ছে দখল,
রেহাই পাচ্ছে না শিশু –নারী,
মসজিদ-মন্দির-গির্জা প্যাগডা,
শ্মশান-গোরস্থান;দেখবার কেউ নেই!
যে সীমায় রাজনীতিকের কাছে আইন
ঠুটো জগন্নাথ,বিচারালয়ের রায়
উপেক্ষিত-মূল্যহীন! তাঁর পরও
নববর্ষ চোদ্দ শ বাইশ এ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌনাচার! এ লজ্জা কার…” (একটা স্বচ্ছ স্বীকারোক্তি)

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের ঐতিয্যবাহী অনুষ্ঠান।আবহমান কালের এ অনুষ্ঠানে বাঙালি অস্তিত্ব মিশে আছে । যা আমাদের দেশ প্রেমে আবদ্ধ করে। ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় সংহতি রক্ষায়। সব বাধা পেরিয়ে নতুন শপথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় ।হাজার বছর ধরে আমরা যেমন ঐক্যবদ্ধভাবে সহাবস্থান করে বসবাস করছি । আগামিতে সে বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।এই হোক নববর্ষ১৪২৩ এর প্রত্যাশা।

মুস্তাক মুহাম্মদ