বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ চায়, নিজেরা রেফারি থাকবে। নিজেরাই লাইন্সম্যান থাকবে। একতরফা খেলে জয়ী হবে। কিন্তু একতরফা খেলা হবে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দল কল্যাণ পার্টির এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন মির্জা ফখরুল। বুধবার দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডের শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা হয়।রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক হবে। কিন্তু সংবিধানকে তাঁরা কেটেকুটে কাগজে পরিণত করেছেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবে আরেক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে মির্জা ফখরুল দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ও গণমাধ্যম একসঙ্গে যায় না। শুধু গণমাধ্যম নয়, এখন রাজনীতি-অর্থনীতি কোথাও স্বাধীনতা নেই। সব আওয়ামী লীগের হাতে চলে গেছে।মির্জা ফখরুলের ভাষ্য, অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখন এই নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, আপনারা রেফারি-লাইন্সম্যানসহ সবাই অত্যন্ত সুন্দরভাবে খেলবেন, গোল দিয়ে যাবেন, আর আমাদের খেলতে দেবেন না- এই খেলা হবে না। একতরফা খেলা হবে না, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া খেলা হবে না।নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও আপত্তি রয়েছে তাদের।বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মঙ্গলবারই বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না তারা।তার একদিন বাদে বুধবার কল্যাণ পার্টি আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মহাসচিব ফখরুল এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাথ্যা করেন।আপনারা (সরকার) বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে হবে। সংবিধান তো আপনি ভেঙে-কেটে-ছুড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে এখন যেটা তৈরি করেছেন, সেটা তো সংবিধান না, আপনারদের মনগড়া একটা কাগজ তৈরি হয়েছে।আপনাদের অধীনে নির্বাচন হওয়া কঠিন, এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। সহায়ক সরকার প্রয়োজন হবে নির্বাচনকালীন সময়ে,” বলেন তিনি। সেই নির্বাচনকালীন সরকারের গঠন-কাঠামো নিয়ে আলোচনায় বসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।

বাংলাদেশে বর্তমানে এক ব্যক্তির শাসন চলছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন বিএনপি মহসচিব।শাসন বিভাগ বিচার বিভাগকে কাজ করতে দিচ্ছে না বলে প্রধান বিচারপতির অভিযোগটি তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে যেটা চলছে, এক দলের শাসন চলছে, এক ব্যক্তির শাসন চলছে।এখানে আর অন্য কিছু নাই। দেশে এমন একটা শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে যাকে একটা ফ্যাসিবাদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, অন্য কারও সাথে নয়,বলেন তিনি।ফখরুল বলেন, সেখানে বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, ভিন্ন মতকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যেখানে প্রতিবাদ করলে তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, গুম করা হয়, হত্যা করা হয়; সেখানে গণতন্ত্রের কথা বলা কঠিন।বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতাকে থেকে অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করেন সাবেক কলেজ শিক্ষক ফখরুল।

হাওরে অকাল বন্যা নিয়ে তিনি বলেন, অনেক দিন পরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী, গিয়ে কিছু ত্রাণের কাজ করে এসে উল্টো আবার বিএনপিকে দোষারোপ করলেন।তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন কেষ্টা বেটাই চোর। সবকিছুতেই বলতে চান যে বিএনপিই এর জন্য দায়ী।

হাওরে বন্যার মধ্যে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের বিষয়টি তুলে ধরে সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী ফখরুল বলেন, এরা এই দেশটাকে মনে করছে তাদের একটা বিনোদনের জায়গা। এখান থেকে তারা অর্থ উপার্জন করবে, আর বিদেশে ঘুরবে।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব তো বলেই দিয়েছেন, যা আয়-টায় করছো, তা নিয়ে তো বিদেশে পালিয়ে যেতে হবে, এখানে থাকতে পারবে না, যদি দলকে ক্ষমতায় রাখতে না পার।বিএনপিকে ভারতবিরোধী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের চিহ্নিত করার প্রতিক্রিয়ায় ফখরুল বলেন, আমি কখনও ভারতবিরোধী নই, আমার দল কখনও ভারতবিরোধী নয়, আমার জোট (২০ দল) ভারতবিরোধী নয়।ভারত আমাদের প্রতিবেশী, বন্ধু। যুদ্ধের সময়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমি নতজানু হয়ে আমার সব কিছু বিলিয়ে দেব, আমার স্বার্থ আমি পাব না।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারই পররাষ্ট্র নীতিকে ‘নতজানু’ করেছে বলে দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব।রাজধানীর তোপখানা সড়কে জাতীয় শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক কল্যাণ পার্টির উদ্যোগে ‘রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা আজাদ মাহবুব, মো. ইলিয়াস, সাহিদুর রহমান তামান্না, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, আবুল কাশেম ভুঁইয়া, স্বাধীনতা ফোরামের আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, জিয়া নাগরিক ফোরামের মিয়া মো. আনোয়ার, জাতীয় নাগরিক মঞ্চের ইসমাইল হোসেন তালুকদার খোকন বক্তব্য রাখেন।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় ফখরুল বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।তিনি বলেন, এই সরকার সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দুর্ভাগ্য আমাদের যে আওয়ামী লীগ ও মুক্ত গণমাধ্যম-এটা একসাথে যায় না। তারা যতবার ক্ষমতায় এসেছে, প্রথম আক্রমণ করেছে গণমাধ্যমের ওপর।আজ দেশে না আছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, না আছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, না আছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সব কিছুই একটা বিশেষ গোষ্ঠির হাতে চলে গেছে, আওয়ামী গোষ্ঠির হাতে চলে গেছে। তাদের বাইরে এখানে কিছু করতে পারবে না।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতেও পরামর্শ দেন তিনি।বিএনপি সমর্থিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগ এই আলোচনা সভায় সাংবাদিকরা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিক নির্যাতনের নানা চিত্র তুলে ধরেন।বিএফইউজের সভাপতি শওকত মাহমুদের সভাপতিত্বে ও বিএফইউজের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ ও ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধানের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন রুহুল আমিন গাজী, এম এ আজিজ, আবদুল হাই শিকদার, আবদুস শহীদ, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, কাদের গনি চৌধুরী, মোদাব্বের হোসেন, খোরশেদ আলম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক মোরসালীন নোমানী, বাংলাদেশে ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম মহসীন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ইলিয়াস খান বক্তব্য রাখেন।

পরে বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের ওপর এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল।