“ঈদ মানে সর্বদা আনন্দ।হয়তো কম নাহয় বেশী।” তবুও ঈদে অানন্দের কমতি থাকেনা।তবে সবার মতে ঈদ ছোটবেলায় বেশী অানন্দের ও খুশীর। আমার ঈদ কেটেছে এই পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত।

আমি যখন ক্লাস টু তে তখন সময় ২০০২ সাল।বাবা মা দু’জনে দর্জি। তাও কাজ করতো ঘরে।রমযান মাস মানে দর্জি পাড়ায় সেলাই মেশিনের গড় গড় শব্দ।প্রতিদিন লোকে ভরপুর থাকতো ঘর।বাবা মা ঠিকমতো ইফতার করতো না। আমি কেনাকাটা করতাম তবে এতো অানন্দ নিয়ে বাজারে যেতে পারতাম না।নানা ভাই পাঠালে তা দিয়ে করতাম।

কিন্তু সেইবার ঈদে কাজের চাপ বেশি পড়ে। তাই ২৮ রমযান পর্যন্ত কিছু কেনাকাটা পারিনি । বাড়ীর সবাই নতুন জামা ক্রয় করে অনেক খুশি। মা শুধু মিথ্যা সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে।বড় ভাই গঞ্জ থেকে নিয়েছে হয়তো একটা শার্ট আর একটা পেন্ট। আমি আর ছোট ভাইর কিছু কিনাই হল না।বাবা অন্য মানুষের ঈদের খুশি ইচ্ছে পূরণ করতে নিজের সন্তানদের কথা রাখতে কষ্ট হচ্ছে।বাড়ির সবাই সেমাই চিনি সব সাধ্যমতো কিনেছে ।আমার পরিবারের কিছু কিনাই হল না।বাবা সবসময় বলতো “আমি যদি ওদের কাপড় তৈরি না করি দিই ওরা মন্দ কথা বলবে। বাবার মুখের দিকে ছেয়ে বুঝতে পারতাম তাই আমি কখনো চাপ দিতাম না।

যখন ঈদের চাঁদ ওঠেছে তখন বাবা বাজারের ব্যাগ নিয়ে গঞ্জে ছুটে যেতো এক ঘন্টার জন্য।সে সময় যা হাতের কাছে পেতো তা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ীতে ফিরেতো। আবার শুরু করে সেলাই।হয়তো ইফতার করেনি। তবুও মুখে হাসি নিয়ে শুরু করে সেলাই।

বাবা কে কান্না চোখে মা বলতো, বাড়ির সবাই কিছুনা কিছু কিনেছে আমার ছেলের কিছু কিনাই হল না।কাল ঈদে কি গায়ে দিয়ে যাবে।কাল কেমনে ঈদে করবে। অভাব অনটনে হাতে টাকা থাকলে আমি চলে যেতাম মার্কেটে। কিন্তু অর্থনীতি আমাদের এমন ছিল কিনাকাটা তো দূরের কথা। চিন্তা করাই ছিল স্বপ্নের। মা এর স্বপ্ন ছিল কোন রকমে যদি কিছু সদাই করতে পারা যাতো তা’হলে সবার মতো একটু আনন্দ করতে পারতো ছেলেটা রাত ১১টা।বাবা তখনো সেলাই করে।মা অনেক হতাশাও গম্ভীর চিন্তায়। বাবা আমাকে ডেকে বলে, এই মাসের অনেক কাজ করে অনেক টুকরা কাপড় জমে গেছে সেই টুকরা কাপড় একত্রে করে তোকে একটা শার্ট সেলাই করে দিই” দশ রকম দশ কাপড় দিয়ে আমাকে একটা শার্ট সেলাই করে দিলো। মা একটু চিন্তা মুক্ত হল।

ঈদের দিন সকালে অন্য সবার মতো আমিও ছুটে যাই বাড়ির সামনে পুকুরে।গরিবের ছেলে বলে জায়গার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।সবাই সাবান শ্যাম্পু নিয়ে এসেছে আর আমি শুধু একটা তোয়ালে নিয়ে যাই। সবার পাশ কেটে যদি সুযোগ পাই কোন রকমের গোসল করে উঠে আসতাম।

এসে মা কে বলতাম আমি লাল সেমাই খাবো।মা কাপড়ের আঁচল দিয়ে গা মুছে দিতো।আমি লাল সেমাই খেয়ে বাবার কাজ থেকে ৫টাকা আর মায়ের কাজ থেকে ৫টাকা নিয়ে ঈদে যেতাম। বাড়ির কেউ সেলামীর টাকা দিতো না।কারন আমার বাবা কাউকে দিতে পারতেন না। তাই কেউ আমাদের সেলামি দিতো না। ঈদে গিয়ে একটা গাড়ি কিনে নিয়ে এসে মাকে বলতাম মা তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।মায়ের দুনয়নে তখন শুধু অশ্রু। বুঝতাম না কেন এই অশ্রু।

মা তখন বলতো কেউ যদি ঈদের সেলামি দিতে চায় তা না নিতে।কারন আমরা গরিব কাউকে দিতে পারবো না।তাই কারো কাজ থেকে সেলামি নিতাম না।আর যদি কেউ দিয়ে দিতো মা তখন তা সঙ্গে সঙ্গে মাটির ব্যাংকে রেখে দিতো আর বলতো ঈদের পর স্কুলে যেতে খাতা কলম কিনে দিবো।

ঈদের দিন নানা ভাইর বাড়িতে যেতাম। তখন নানা ভাই নতুন টাকা দিতো।আমার নানা ছিল বেশ ভালো আমাদের অনেক টাকা দিতো।তা নিয়ে এসে সবাই কে বলতাম আমার কাছে নতুন টাকা আছে।এভাবে চলে যেতো ঈদ। আবার স্কুলে আসা যাওয়া শুরু আমাদের। আর দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে নেমে যেতো বাবা মা।

২০১৫ সালে বিরহের প্রথম ঈদ কেটেছে। না বুঝে এক রমণীর প্রেমে পড়ে তার মাশুল দিতে হল।তাই ঈদে অানন্দের সাথে দু’ এক ফোঁটা অশ্রু যোগ হল। মার্কেট করি নাই।বড় ভাই ঢাকা নিউ মার্কেট থেকে নিজের মতো করে অনেক কাপড় নিয়ে এসেছে।বাড়ির সবাই এসে দেখছে। আমি সবার মতো দেখি, কিন্তু আমার কাপড় তা নিয়ে কোন ইন্টারেস্ট নাই। মনে হচ্ছে একা একা ঈদ করতেছি।

তবে ২০০২ সালের মতো দারিদ্রসীমা আজ নেই আমার পরিবারের।অাল্লাহর রহমতে সচ্ছল। আমার মানিব্যাগ ঈদের জন্য ৫ হাজার টাকা আছে।যা ইচ্ছে তা কেনাকাটা করতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে করে না।কনো একসময় টাকার জন্য মানুষের দিকে চেয়ে ছিলাম।কিন্তু আজ বাড়ির সবাই কে সেলামি দিতে অনেক ভালো লাগে। ঈদে সবার সাথে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে নামায আদায় করি।

২০১৬ সালে ঈদ এসেছে নতুন বার্তা নিয়ে।কারন অনেক পত্র পত্রিকা আমার লেখা প্রকাশ হয়।নিজে ঈদের অানন্দের সাথে আরো একটু বাড়তি অানন্দ পেয়ে থাকি।বড় ভাইয়ে সবার জন্য ২২ হাজার টাকার মার্কেট করছে ঢাকা থেকে।আমার ছোট ভাইর জন্য অনেক কিছু কেনাকাটা করেছে।আমি আবার ঈদের জন্য সেমাই, চিনি, নারিকেল সহ অনেক রকম বাজার সদাই করি।মায়ের চোখে আজো অশ্রু তবে তা আনন্দের।বাবার আজো আমাকে ঈদের আগের রাতে ডাক দিয়ে বলে, তবে তা দশ রকমের কাপড়ের শার্টের জন্য না, তা হল কাল খুব সকালে তার বোনদের সাথে মোবাইলে কথা বলার জন্য আমাকে কল দিতে।আর গাঁয়ের গরিব মানুষের সাথে বেশি করে কোলাকোলি করতে।

ঈদের দিনের প্রথম প্রহরে ছুটে যাই শানবাঁধানো ঘাটে। আজ কেউ বাঁধা দিচ্ছে না।আজ কেউ কটু কথা বলছেনা,আজ সবাই সবার মতো করে গোসল করছে।গোসল করে এসে আজও মায়ের আঁচলে মুখ লুকাই মা সেই ছোট বেলার মতো গা মুছে দেয়।দুনিয়াতে সব কিছুর পরির্বতন হয়েছে কিন্তু মায়ের ভালবাসা ঠিক আগের মতো আছে।চুলপরিমান পরিবর্তন হয় নাই।
ছোট ভাই এসে প্রস্তুত সেলামির জন্য। কিন্তু মায়ের সামনে সে সেলামী নিবে না। কারন মা টাকার হিসাব নিবে তাই গোপনে তাকে ৫০০ টাকা সেলামি দিতে হবে। আজ ৫০০টাকা নিয়ে যায় ছোট ভাই কিন্তু কয়েকবছর আগে আমি ৫টাকা নিয়ে যেতাম।

ঈদ থেকে এসে মাকে প্রথমে সালাম করি।তারপর বাবা আর বাড়ির সবাই কে।জমে উঠেছে বাড়ি।সবাই বেড়াতে যাচ্ছে। আজ নানা আসবে না।কারন সে আজ না ফেরার দেশে। হয়তো কয়েকবছর আগে নানা ভাই ছাড়া ঈদ করতে পারতাম না। আজ লাল সেমাই নেই।কারণ বাবা আজ গঞ্জে গিয়ে লাল সেমাই না কিনে লাচ্ছি সেলাম ক্রয় করেছে। মায়ের হতাশা অাজ নাই।

সাজ্জাদ হোসেন সাখাওয়াত