জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করে বয়স্ক ভাতা উত্তোলনের অভিযোগ তদন্ত করতে এসে পাওয়া গেছে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ও বয়স্ক ভাতা প্রদানে করা হয়েছে সীমাহীন অনিয়ম আর দুর্নীতি।
মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেন সমাজ সেবা কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান।

প্রতিবেদন পাওয়ার পর জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি অভিযোগে ৪টি বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল করেছে উপজেলা প্রশাসন। এরা হলেন, ঐ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মৃত নাছির উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মতালিব, মৃত মজি উল্যাহর ছেলে মহবত আলী, মনির উদ্দিনের স্ত্রী কারিমা খাতুন ও মামুদ হোসেনের ছেলে ইদ্রিস আলী। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঐ উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান ।

কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মুকুল সরকারসহ কতিপয় ব্যক্তি উপজেলা নিবার্হী অফিসার বরাবরে লিখিত অভিযোগে জানা যায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সমাজসেবা বিভাগ কর্তৃক বাছাই কালীন জাতীয় পরিচয়পত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধি করে বয়স্ক ভাতার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এমন অভিযোগে প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে বিষয়টি সংশিষ্ট সমাজসেবা অফিসার তদন্ত টিমের মাধ্যমে অভিযোগটি তদন্ত করা হয়। তদন্ত টিম সরেজমিন ও নির্বাচন অফিসের মাধ্যমে ভোটার আইডি কার্ড যাচাই কালে বয়স বৃদ্ধির অভিনব জালিয়াতি ধরা পড়ে। তারই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সমাজ সেবা অফিসার আবু সুফিয়ান জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স বৃদ্ধি করা ৪টি বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিলসহ জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য উপজেলা নিবার্হী অফিসার বরাবরে সুপারিশ করেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা নিবার্হী অফিসার মামুন ভুইয়া (চলতি দায়িত্ব) জানান, জালিয়াতির সাথে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, দলগ্রাম ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডে নয়। গোটা ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডেই জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে বয়স্ক ভাতার কার্ড করা হয়েছে এমন সংখ্যা অনেক। বয়স বাড়ানোর অভিযোগ কালীগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নেই কম-বেশী রয়েছে। নির্বাচন অফিসের মাধ্যমে ভোটার আইডি কার্ড যাচাই করলে বেড়িয়ে আসবে থলের বিড়াল।

দলগ্রাম ইউনিয়নে ২ নং ওয়ার্ডে একই ব্যক্তির নামে রযেছে একাধিক কার্ড। প্রতিবন্ধী নয়, অথচ ডাক্তারী সনদ নিয়ে করা হয়েছে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। অন্য ইউনিয়নের বাসিন্দাকে দেয়া হয়েছে বয়স্ক ভাতার কার্ড। মোতালেব, তাসলিমা, আব্দুল হাকিম, আবুবক্কর, নাছিরউদ্দিন, অলিমা খাতুনরা প্রতিবন্ধী না হলেও ডাক্তারী সনদের মাধ্যমে হয়েছে তাদের প্রতিবন্ধীকার্ড। অথচ এমন অনেক প্রকৃত প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাদের প্রতিবন্ধী কার্ড হয়নি।

১০৫ বছর বয়স আব্দুল জব্বার, ৬৫ বছরের উর্ধে রমজান আলী, ৮২ বছরের ছুফিয়া খাতুন, ৮৬ বছরের আফজাল হোসেনের কার্ড হয়নি বয়স্ক ভাতার । ওসনা বা রোসনা নামে ‘বয়স্ক’ ও ‘বিধবা’ তালিকায় কার্ড হয়েছে । কিন্তু, প্রকৃত ওসনা বা রোসনা বেগম ভাতা পায়নি। অথচ, দুই নামেই ভাতার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে বেড়িয়ে আসবে কে বা কারা উত্তোলন করেছে ওসনা বা রোসনা নামে কার্ডের টাকা।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান খ.ম. শফিকুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, গ্রাম পুলিশ শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে শুনেছি। তবে গ্রাম পুলিশ এসবের সাথে জড়িত নয় বলে চেয়ারম্যানের দাবী। বাতিল হওয়া মহবত আলীর ভোটার আইডি কার্ডে প্রকৃত জন্ম তারিখ রয়েছে ০২-০৭-১৯৬৮ ইং। জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে ০২-০৭-১৯৪৮ইং।

১৩ -০৮-২০১৭ তারিখে অভিযোগকারীদের অভিযোগের দুইদিন পর ১৫-০৮-২০১৭ তারিখে চেয়ারম্যান একটি জন্ম সনদ ইস্যু করে ঐ জালিয়াতি আইডি কার্ডে উল্লেখিত বয়সটিকে বৈধ করার হীন কাজটি করে জালিয়াতি চক্রটিকে উৎসাহিত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত ১৪ জুন’১৭ তারিখে সকল ভাতাসমুহের কার্ড সমাজ সেবা কার্যালয় কর্তৃক চূড়ান্ত করা হয়।

সমাজ সেবা কর্মকর্তা জানান, ২০১৫-১৬ অর্থ বছর পর্যন্ত কালীগঞ্জ উপজেলার ৮ ইউনিয়নে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতা সুবিধাভোগী সংখ্যা ছিল ৮,৯৮৩ জন। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৬,৮০৪ জন বৃদ্ধি পেয়ে ১৫,৭৮৭ জন উন্নীত হয়েছে। এক সাথে এত কার্ড বাছাই করতে অসাবধানবশতঃ কিছু ক্রটি হয়েছে। সময় স্বল্পতার সুযোগে কেউ কেউ অনিয়ম করেছে। এসব তদন্তের মাধ্যমে বাতিল করা হবে।