তিন সদস্যের উপাচার্য (ভিসি) প্যানেল মনোনয়নের জন্য চলতি বছরের ২৯ জুলাই ডাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিশেষ সিনেট সভা অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই সভায় মনোনীত তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেলকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।পাশাপাশি ছয় মাসের মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সিনেট গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ঢাবি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) এ রায় ঘোষণা করেন।আদালতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আশিকুল হক। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান। পরে মোস্তাফিজুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, রুল পুরোপুরি মঞ্জুর করে রায় দিয়েছেন। ফলে ২৯ জুলাই ডাকা বিশেষ সভা ও ওই সভায় মনোনীত তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল অবৈধ। এছাড়া ছয় মাসের মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সিনেট গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ঢাবি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

সিনেট সভা আহ্বানের বিষয়ে গত ১৬ জুলাই ঢাবির রেজিস্ট্রার একটি চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ আর ২১ (২) ধারার অর্পিত ক্ষমতাবলে উপাচার্য, ২৯ জুলাই বিকেল ৪টায় সিনেটের বিশেষ সভা আহ্বান করেছেন। বিশেষ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩, ১১(১) ধারা অনুযায়ী চ্যান্সেলরের মাধ্যমে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের জন্য তিনজনের একটি প্যানেল মনোনয়ন করা হবে। ভাইস চ্যান্সেলরের প্যানেলে যাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করার জন্য প্রস্তাব করা হবে, নাম প্রস্তাবের সময় তাদের লিখিত সম্মতি সিনেট চেয়ারম্যানের কাছে পেশ করতে হবে। সভায় উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হয়।

১৬ জুলাই ঢাবি রেজিস্ট্রারের দেয়া এই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৫ জন হাইকোর্টে রিট করেন। তারা রিটে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েটের অনেক প্রতিনিধির পদ খালি। সিনেটের প্রতিনিধি হিসেবে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েটদের পদ পূরণ না করে সিনেট সভা ডেকে উপাচার্য-প্যানেল মনোনয়ন করা ঠিক নয়।

২৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েটসহ মোট ১৫ জনের করা ওই রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্ধারণ না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট গত জুলাইয়ে যে বিশেষ সভা করেছিল । এ বিষয়ে এর আগে হাই কোর্টের দেওয়া রুলের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়।যথাযথভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সিনেট গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

এর আগে আপিল বিভাগ সিনেটে মনোনীত ওই তিন সদস্যের প্যানেল নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত করে হাই কোর্টে রুল নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিল। আর রুল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত তখনকার উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে সেই আদেশে জানানো হয়েছিল।কিন্তু আট বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় রুল নিষ্পত্তির আগেই গত ৪ সেপ্টেম্বর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে ‘সাময়িকভাবে’ উপাচার্যের দায়িত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।গত ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভবনে হওয়া সিনেট সভায় উপাচার্য নির্বাচনে যে তিন জনের প্যানেল অনুমোদন করা হয়েছিল, সেখানে অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের নাম ছিল না।

ফলে ওই সিনেট সভা এবং তিন সদস্যের প্যানেল অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের তেমন কোনো প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিকজ কার্যক্রমে পড়ছে না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। বেঞ্চ রুল জারি করেন এবং সিনেট সভার ওপর স্থগিতাদেশ দেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ ১৯৭৩ সালের ২০(১) ধারা অনুযায়ী সিনেট গঠন না করে ২৯ জুলাই ডাকা সভাটি কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপিল করেন। এরপর ২৬ জুলাই হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ ৩০ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। ছাত্র-শিক্ষকদের আপত্তি ও অসন্তোষ সত্ত্বেও এ স্থগিতাদেশের সুবাদে কোনো প্রকার আইনি বাধা ছাড়াই ২৯ জুলাই সিনেটের বিশেষ সভাটি যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় তিন সদস্যের ভিসি-প্যানেল মনোনীত করা হয়।এই তিনজন সদস্য হলেন সদ্য-সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দিন, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও নীল দলের আহ্বায়ক আবদুল আজিজ।৩০ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। ওই দিন রিট আবেদনকারী পক্ষ ৩ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত সময় নেন। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার আবেদনটি ফের শুনানিতে ওঠে। ওইদিন আপিল বিভাগ তিন সদস্যের ভিসি-প্যানেলের পরবর্তী কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে ২৯ জুলাইয়ের সিনেট বৈঠক নিয়ে হাইকোর্টের জারি করা রুল চার সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। সে মতে ২১ আগস্ট থেকে এ রুল শুনানি শুরু হয়। গত রোববার (৮ অক্টোবর) রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর)রায়ের দিন ধার্য এদিকে উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ০৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামানকে সাময়িকভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়।তবে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর চাইলে তাকে (আখতারুজ্জামান) যেকোনো সময় দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত দিতে পারবেন।