আমার বয়সী ছেলে মেয়েরা যখন সকালে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় তখন আমার খুব খারাপ লাগে। ওরা যখন স্কুলে যায় আমি তখন নানীর কোলে চরে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে যাই। আমি স্কুলে যেতে চাই, মানুষের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে আমার আর ভাল লাগে না।
মন খারাপ করে এমন করেই কথাগুলো বলছিলেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের রিতা (১০) অসুস্থ ছোট্ট শিশু। জন্মের চার বছর পর থেকে বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে শয্যাশায়ী অবস্থা তার। অন্যের সাহায্য ছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। একা একা একটু চলতে ফিরতে গেলেই ভেঙ্গে যায় তার পা। যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকে। গত ৬ বছরের মধ্যে তার দুটি পা একে একে ১০-১২ বার ভেঙ্গেছে। অর্থাভাবে ও সঠিক চিকিৎসার জন্য ছোট্ট মেয়েটি দিনদিন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বলছে, এটা এক ধরনের জটিল রোগ। এ রোগ সহজে ভাল হবার নয়। তবে বয়স বৃদ্ধি পেলে এটা ধিরে ধিরে ঠিক হয়ে যাবে। এই ঠিক হতে হতেই বড় হয়ে সে সামান্য পঙ্গুত্ব বরন করতে পারে।
রিতার বাবার নাম রতন আলি। বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে। পেশায় সে ক্ষৌরকার (নাপিত)। ২ ছেলে, ২ মেয়ের মধ্যে রিতা দ্বিতীয়। অভাব অনটনের সংসারে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে মেয়ের চিকিৎসা সহ ভরন পোষনের দ্বায়ভার একে বারেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে রিতার মা তার মেয়েকে নানীর কাছে দিয়ে দিয়েছেন ছোট বেলাতেই।
রিতার নানী জমেলা খাতুন জানান, রিতার বয়স যখন ৪ বছর তখন থেকেই ওর পায়ের হার ভাঙ্গা রোগ দেখা দেয়। প্রথম দিকে রিতার বাবা চিকিৎসা করান। পরে সে অপারগ হয়ে গেলে তখন তাকে তার মেয়ের আশা ছেড়ে দেয় এবং রিতাকে নানীর কাছে দিয়ে আসে। রিতার নানী বলেন আমার মেয়ে তখন অঝোড় ধারায় কান্না করতে থাকে আর বলে চিকিৎসার অভাবে কি আমার মেয়ে মরে যাবে। তখন থেকে আমি রিতাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। আমি আজ প্রায় ৬ বছর রিতাকে মানুষ করছি। এর মধ্যে অনেকবার ওর পা ভেঙ্গে গেছে। টাকার অভাবে ভাল চিকিৎসা করাতে না পেরে ওর ভাঙ্গা পায়ের হার এলোমেলো ভাবে জোড়া লেগে এখন পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, অভাবের সংসারে ওকে নিয়ে প্রতিদিন সকালে বের হই মানুষের সাহায্য সহযোগীতার জন্য। সারা দিন ওকে কোলে নিয়ে পাবনা শহর ও বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে যে কয়টা টাকা পাই তা দিয়ে ওষুধসহ চাল- ডাল কিনে নিয়ে যাই। এর আগে ডিবি গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিতাকে একটা প্রতিবন্ধি কার্ড করে দিয়েছিল। সেখান থেকে সামান্য কিছু টাকা আমরা পাই।
মানুষের সাহায্য সহযোগীতায় যে টাকা পাই তা দিয়ে রিতার চিকিৎসার জন্য সাধ্য অনুযায়ী অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না। সব ডাক্তারই বলেছে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করাতে। কিন্তু সেখানে ভর্তি করানোর এতো টাকা আমি আমার নেই।
এ নিয়ে কথা হয় বিশেষজ্ঞ অর্থপেডিক্স ডা. খতিব শফিউর রহমানের সাথে। তিনি জানান, মেয়েটির এই রোগ কে ডাক্তারি ভাষায় বলে অষ্টোজেনেসিস ইন পারফেক্টা। এটা হারের পরিপক্কতার অভাবে হয়ে থাকে। চলাফেরা করতে গিয়ে বার বার পায়ের হার ভাঙবে। সঠিক ভাবে হার জোরা না লাগায় সে ধিরে ধিরে পঙ্গুত্ব বরন করবে। মেয়েটির উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানোর কথাও তিনি উল্লেখ্য করেন।