আর কয়দিন পরেই বিজয় দিবস। এই দিনে পুরো জাতি মহা আনন্দে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে লাল সবুজের আলোকছটায় হয়ে ওঠে বর্ণিল। পোশাক, সাজসজ্জা ও আনুষঙ্গিক আরও কত কি যে এই উৎসবে প্রান ফিরে পায় তা বলে শেষ করা যাবে না। তাই অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে দিবস পালনের প্রস্তুতি। দিনে দিনে বিজয় দিবস পালন করা হয়ে উঠেছে সার্বজনীন মহা উৎসবে।

ব্যতিক্রম মনে হয় শুধু আমি। কষ্টে নীল হয়ে যাওয়া এই মন কোন আনন্দেই মেতে ওঠে না। প্রতি মুহূর্তে সেই কাল রাতের পাশবিক ঘটনা আমাকে দগ্ধ করে। হ্যাঁ, গত রাত ছিল আমার জীবনের কালরাত। ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জনের কিছুদিন আগে, আজ অর্থাৎ ১০ নভেম্বর পাক হায়েনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় আমার বাবা ও মাকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁদের শরীরে ৪০-৫০ টা গুলি ও বেয়োনেটের চিহ্ন ছিল। দারোয়ান হাফিজুল্লাহ বাঁধা দেওয়ায় তাকেও হত্যা করা হয়। আমার বাবা মোঃ আব্দুল হামিদ ছিলেন ভোলা জেলার দৌলতখান থানার সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। আর মায়ের নাম জেবুন্নেসা বেগম। বাবা শারীরিক অসুস্থতার কারনে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু উনি সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা, খবর আদান-প্রদান, খাবার জোগানসহ বিভিন্নভাবে বাবা ও মা মুক্তিযুদ্ধে ভুমিকা রাখেন। আমার চোখের সামনে বাবা ও মায়ের সাথে পাশবিক আচরণ করা হয়েছে।

আমার নানার হাত ধরে আমরা রাজশাহীতে নানার বাড়িতে উঠলাম। আমার নানা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন আমার বাবার পেনশন, গ্রাচুইটি সহ অন্যান্য পাওনাগুলো আদায় করবার। কিন্তু তিনি পারেননি। আমি ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিটা সরকারের কাছে আবেদন করেছি, কিন্তু চিঠি চালাচালি ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই হয়নি। অফিসিয়াল নিয়মানুযায়ী তারা বাবার সার্ভিস বুক সহ অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু আমি এসব কোথায় পাব এখন? বাবা-মাকে নিয়ে যাবার সময় ওরা আমাদের বাসার সবকিছু তছনছ করেছে ও লুটপাট করেছে। চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় বাবা-মাকে নির্যাতন করতে করতে যখন হায়েনাগুলো ধরে নিয়ে যায় তখন আমি আমার অবুঝ ভাইবোনের কান্না থামাবো, না নিজের চোখের জল মুছবো? না বাবার সার্ভিস বুক খুঁজবো? সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে সামান্য জ্ঞানটুকুও কি নেই তাদের যারা বাবার সরকারী কাগজপত্র চায়?
আমরা খালি হাতে দৌলতখান থেকে ফিরে এসেছি। সরকারী সুবিধাগুলো পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের চার ভাইবোনের জন্য বাবা রেখে গেছেন শুধুমাত্র রাজশাহী শহরে একখণ্ড জমি। আমরা অনেক কষ্টে বড় হয়েছি কিন্তু বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র স্মৃতি জমিটা আমরা বিক্রি করিনি। এই এক খন্ড জমি তো শুধু জমি নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে আমার বাবা-মায়ের স্মৃতি, এই জমির মাটিতে আছে তাঁদের পদচিহ্ন। এখানে জড়িয়ে আছে অনেক আবেগ, অনেক ভালবাসা।নগদ টাকার অভাবে আমরা এখানে কোন স্থাপনা গড়তে পারিনি, কিন্তু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম।

গত বছর রাজনীতির লালসার ছত্রছায়ায় লালিত কিছু ভুমিদস্যু আমাদের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমিটা দখল করে নেয়। খবরটা শুনে শোকে পাথর হয়ে যাই আমরা। আমার বাবা-মায়ের রক্তের বিনিময়ে এটাই বুঝি আমাদের পাওনা ছিল? বাবা-মা হারানোর যন্ত্রণা, নিজের চোখে দেখা সেই পাশবিক নির্যাতনের যন্ত্রণা, বাবার সরকারী সুযোগ সুবিধাগুলো না পাওয়ার যন্ত্রণা প্রতি মুহূর্তে আমাকে দগ্ধ করে তাই তো কোন আনন্দ বা উৎসবে আমি নিজেকে জড়াতে পারি না। তাঁদের শরীরের বেয়োনেটের খোঁচাগুলো শত শত গুন বেড়ে আমাকে বিদ্ধ করে। কেউ জানে না কিভাবে আমরা আমাদের বাবা-মা হত্যার বিচার পাবো, বাবার সরকারী চাকুরীর সুবিধাসমুহ পাবো, বাবার রেখে যাওয়া জমিটা, অবৈধ দখলদারের হাত থেকে মুক্ত করবো? তাই সব বিচারের দায়িত্ব বিধাতার উপর ন্যাস্ত করলাম।

কিন্তু শোন এই দেশ, শোন এই জাতি, আমি আমার বাবা-মা হত্যার বিচার চাই, আমাদের জমি ফেরত চাই, বাবার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দেখতে চাই, আমরা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি চাই। এই কথাগুলো অনন্তকাল ধরে তোমাদের অন্তরজ্বালায় জ্বালাবে। তোমরা কখনও এই দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারবে না।
তবে দৌলতখানবাসীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমার বাবা-মাকে ঠিকই মনে রেখেছেন। মাঝে মাঝে কিছু পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখালেখি হয়েছে, যারা একাজে জড়িত ছিলেন তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

– নাহিদী ইয়াসমীন, ১০/১১/২০১৭