বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এই তিনটি দিবসকে সামনে রেখে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছে দেশের ফুল উৎপাদনের প্রধান জনপদ যশোরের গদখালির ফুল চাষিরা। বর্তমানে তারা মহাব্যস্ত সময় পার করছেন। ক্ষেত থেকে সময়মতো পর্যাপ্ত ফুল পেতে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষিরা। আবহাওয়া ফুল চাষের অনুকূল থাকলে এ তিন দিবসে দেশের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে তারা। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের রাস্তার পাশের জনপদ গদখালী। যশোর থেকে গদখালির দুরত্ব প্রায় প্রায় ১৮ কিলোমিটার। বাসে যেতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। এখান থেকেই সারা দেশে ফুলের সরবরাহ হয়। ১৩ ফেব্র“য়ারি পহেলা ফাল্গুন-বসন্তবরণ উৎসব। আজ ১৪ ফেব্র“য়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এ দুটি দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে চান তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষেরা। প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের জন্য ফুলই শ্রেষ্ঠ। মানুষের মনের খোরাক মেটাতে গদখালীর ফুল চাষিরা এখন দিনরাত পরিশ্রম করছেন। এবার ফুল দেরিতে ফোটায় গোলাপের কুঁড়িতে পরিয়ে রাখছেন ‘ক্যাপ’। বসন্ত উৎসব, বিশ্বভালোবাসা দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ফুল বাজারে দেওয়া নিশ্চিত করতে তাদের এই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। বিস্তৃীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, জারবেরা, গ্যালেরিয়া ও গ্লাডিওলাসসহ নানা রঙের ফুল দোল খাচ্ছে। চোখ ধাঁধানো এই সৌন্দর্য কেবল মানুষের হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তিই আনে না, ফুল চাষ সমৃদ্ধিও এনেছে অনেকের জীবনে। ইতিমধ্যে বসন্ত উৎসব আর ভালবাসা দিবস উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরগুলোতে ফুলের চালান যাওয়া শুরু হয়েছে।

গদখালী বাজারে এখন জারবেরার স্টিক বিক্রি হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ টাকায়, রজনীগন্ধা ১-৩ টাকায়, গোলাপ রং ভেদে ৬-১৫ টাকায়, গ্ল্যাডিওলাস ৪-১০ টাকায়, এক হাজার গাঁদা পাওয়া যাচ্ছে ৫৫০-৬০০ টাকায়।গদখালি ফুলচাষী কল্যাণ সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম জানান, গত বছর এই সময়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। এবার তা প্রায় দ্বিগুনে পৌঁছাতে পারে।তিনি আরও জানান, ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে রঙিন গ্ল্যাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধা ও গোলাপ বেশি বিক্রি হয়। আর গাঁদা বেশি বিক্রি হয় একুশে ফেব্র“য়ারী ও বসন্ত উৎসবে। ফলে সূর্য ওঠার আগেই প্রতিদিন চাষি, পাইকার ও মজুরের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠে গদখালীর এই ফুলের বাজার। ব্যস্ত গদখালীর ফুলচাষিরা পাইকারদের কেনা ফুল সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে স্তুপ করে সাজানো হচ্ছে, পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে। ঢাকা-চট্রগ্রামের মতো বড় বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ভরে ফুল যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি লেলিন বলেন, ‘সারাদেশে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে যে ফুল বেচা-কেনা হয় তার অন্তত ৭০ শতাংশই যশোরে উৎপাদিত। তবে এবারের বিশ্বভালোবাসা দিবসে ফুলের যেমন উৎপাদন বেশি, তেমনি চাহিদা অন্য যে কোনো বারের তুলনায় বেশি। তাই ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা ফুলের অর্ডার নিচ্ছি।স্থানীয় ক্ষুদ্র পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, সামনে ভ্যালেন্টাইন ডে’তে ফুল বিক্রি বেশি হবে। বাজারে জারবেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুলের চাহিদা বেশি। কৃষকরাও দাম ভালো পাবেন।ফুলচাষি আজগর আলী জানান, এবার তিনি দশ বিঘা জমিতে গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাসের পাশাপাশি জারবেরার চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় বাগানে আগের চেয়ে বেশি ফুল এসেছে। ফলে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। ‘বিভিন্ন রংয়ের গোলাপ এবার কৃষকের ঘরে বিশেষ উপহার হয়ে এসেছে। আমরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার পাচ্ছি। তাদের চাহিদা মতো ফুল সরবরাহ করার জন্য প্রস্তুত আছি, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, তিনটি দিবস সামনে রেখে এবার ফুল বিক্রি প্রায় ৪০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন।

তিনি বলেন, ‘এবার ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম সবই বেশ ভালো। এ অঞ্চলের ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীরা সবাই খুশি। দেশে ফেব্র“য়ারিতে যে পরিমাণ ফুল বেচাকেনা হয়। তার ৭৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় যশোরে। এবার চাহিদা বেশি, চাষিরাও আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এ অঞ্চলে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে ফুলের চাষ করেছেন চাষিরা। বর্তমানে এটি ‘ফুলের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত। এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় ফুলের উৎপাদন বেশি হয়েছে। বিদায়ী ২০১৭ সালে শুধু গদখালি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়। এ বছর তা অতিক্রম করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফুল চাষকে লাভজনক করে তুলতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নানা সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস জানান, এ অঞ্চলে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে ৫শ’ ফুলচাষি বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ করেছেন। বিদায়ী ২০১৭ সালে শুধু গদখালি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়। এবছর তা অতিক্রম করবে বলে আশা করা হচ্ছে।