প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (বৃহস্পতিবার) লন্ডনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সম্মেলনের প্রথম দিনেই দুই প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ত কার্যসূচির মধ্যেও এ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক তাদের পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতারই বহিঃপ্রকাশ। ভারত আমাদের এক ঐতিহাসিক বন্ধু ও প্রতিবেশী। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে দ্ইু প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের ল্যাংকাস্টার হাউজে আজ বিকেলে বৈঠকে মিলিত হন এবং দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমও উপস্থিত ছিলেন। রোহিঙ্গা ও তিস্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বৈঠকে সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথ ইস্যু নিয়েও আলোচনা করেন।

শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনাকালে ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে, যা আমাদের চিন্তার কাছাকাছি। তিনি বলেন, ভারত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়তা করছে।পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভারতের পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের বিশ্ব ভারতী ইউনিভার্সিটিতে ‘বাংলাদেশ হাউস’ উদ্বোধনের বিষয়টিও দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় স্থান পায়।পররাষ্ট্রনীতিতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র তার বন্ধু বদলাতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশী বদলাতে পারে না, তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বই শ্রেষ্ঠ নীতি।’ সেই সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিরও মূল কথা, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিবেশী নীতি অনুযায়ী, আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্জনে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ভারত এ অঞ্চলে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত এক পরাশক্তি। আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ভারতের রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান। ভারত তার এ অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চায়। এদিকে চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়েও ভারত চিন্তিত। চীন, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে।এমতাবস্থায় ভারত বাংলাদেশকে অবশ্যই তার পাশে চাইবে। কিন্তু মিয়ানমারকেও সে হারাতে চায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত রোহিঙ্গা প্রশ্নে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এমন অবস্থায় ভারতের অবস্থান বদল সহজ কিছু নয়। কিন্তু আমাদেরও আঞ্চলিক অঙ্গনে ও বৈশ্বিক অর্জনে ভারতকে পাশে রাখতেই হবে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের এ মুহূর্তের এজেন্ডা হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গা সমস্যাটি একটি আঞ্চলিক বা দ্বিপাক্ষিক সমস্যা বটে।বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেই এ সমস্যার বিস্তার। কিন্তু সমস্যাটি বৈশিষ্ট্যগতভাবে ‘আন্তর্জাতিক’। কারণ, বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শরণার্থী। শরণার্থী সমস্যা আন্তর্জাতিক। এ আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করতে হলে আঞ্চলিক সহযোগিতা যেমন লাগবে, তেমনি লাগবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। বর্তমানে সমস্যাটি যে আকার-প্রকার ধারণ করেছে, তাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কোনোটি ব্যতিরেকেই এর সমাধান সম্ভব নয়। শুধু ‘সাহায্য-অনুদান’ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বিশ্ববাসীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, ১০ লাখ শরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশের ঘাড়েবাংলাদেশ সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই বিবাদমান সমস্যাগুলো নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক ফলও আমরা পেতে শুরু করেছি। শুরুতে রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত মিয়ানমারের পার্শ্ব অবলম্বন করেছে। চীনও মিয়ানমারের পক্ষেই কথা বলেছে। আমেরিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের বক্তব্যও মিয়ানমারের পক্ষেই গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রগুলো তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সমালোচনামুখর ছিল। বাংলাদেশের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রয়াস ও সমস্যার রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে তাদের আগের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে সরকারের মানবিক অবস্থান বিশ্বে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি কূটনৈতিক প্রয়াসের ফলে রাষ্ট্রগুলো তাদের আগের অবস্থান থেকেও সরে এসেছে। তবে, একথাও সত্যি, কোনো সংস্থা বা রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রশ্নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে দমে যায়নি, বরং বিভিন্ন ফোরামে সমস্যার প্রকৃতি ও আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। ফলে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও, রোহিঙ্গা সমস্যা যে মিয়ানমারেরই সৃষ্টি এবং তারা যে গণহত্যাসহ নানা অপরাধে লিপ্ত হয়েছে, তা আজ বিশ্বে প্রমাণিত। বিশ্ব আজ মনে করে, এ সমস্যা মিয়ানমারেরই সৃষ্টি ও তাদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এমতাবস্থায় আমাদের সব কূটনেতিক প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার মতো অপরাধের বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভারত অন্যতম প্রভাবক। এটি উপলব্ধি করেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি লন্ডনে মোদীর সঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি উত্থাপন করেছেন।

দ্বিপাক্ষিক এ বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক রোহিঙ্গা ইস্যুতে বলেন, ‘আপনারা জানেন ভারত তাদের অবস্থান থেকে অনেক সরে এসেছে। মানে পরিবর্তন করেছে। তারা এখন এ বিষয়ে আমাদের অনেক কাছে এসেছে। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা করছে। ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।’ অবস্থান পরিবর্তনের ফলে আমরা আশা করি ভারত রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলবে। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষে কথা না বলা বা নীরবতা বজায় রাখা হয়তো বাংলাদেশের জন্য তেমন ফল বয়ে আনবে না। প্রয়োজন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে জোরালো ভূমিকা পালন করা বা এ লক্ষ্যে অন্তত সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করা। এখানে আরও একটি বিষয় জরুরি, তা হলো, ‘রোহিঙ্গা পুনর্বাসন’ এ সমস্যার সমাধান নয়। প্রত্যাবাসনই এর আইনগত ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একমাত্র সমাধান। এছাড়া এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং রেল ও সড়ক যোগাযোগসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি ভারত আমাদের আগামী দিনের উন্নয়ন ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করবে; এক ঐতিহাসিক প্রতিবেশী-বন্ধুর কাছে এ প্রত্যাশা থাকতেই পারে বাংলাদেশের।