গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিখতে হচ্ছে খোদ মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, বিজিবিসহ সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ের লোকজনকেও। এমনকি একজন বিচারপতিও লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার রাজপথে নেমে অভিনব আন্দোলনের ধারণা দিয়েছেন স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা। তারা সড়কে নেমে মানুষের গাড়ির লাইসেন্স চেক করছেন, যাদের সব কাগজ ঠিকঠাক আছে তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন আর যাদের বৈধ কাগজপাতি নেই তাদের চাবি খুলে নিয়ে পুলিশের সার্জেন্ট ডেকে মামলা দেয়ার পর ছাড়ছেন। এই কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

বুধবার বিকেলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রাজধানীর বাংলামটরে শাহবাগের দিক থেকে উল্টোপথে গাড়ি নিয়ে এলে শিক্ষার্থীরা তার গাড়ি থামিয়ে তাকে সোজা রাস্তায় যেতে বাধ্য করে। তোফায়েল আহমেদ ছাত্রদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করেন তিনি তাদের সাথে কথা বলার জন্যই উল্টোপথে এসেছেন। তিনি এ সময় গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। মন্ত্রীর সামনেই শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয়- ‘আইন সবার জন্য সমান’। কোন ফল না পেয়ে গাড়িতে ফিরে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি উল্টো পথে গাড়ি নিয়ে যাই না”, এর জবাবে শিক্ষার্থীরা তাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি চালককে গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা পথে নেয়ার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে রাজধানীর শনিরআখড়ায় গাড়ি চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে না পারায় সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথকে দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় এমপির বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। তখন এমপিকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন কদমতলী থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মমিনুল ইসলাম রাজীব। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লে এক পর্যায়ে তাকে বেদম মারধর করা হয়। পরে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ইন্স্যুরেন্স আপডেট না থাকার অভিযোগে পুলিশ মামলা দায়ের করলে সাংসদের গাড়িটি ছেড়ে দেন শিক্ষাথীরা।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত শনিরআখড়া দনিয়া স্কুলের সামনে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। পঙ্কজ দেবনাথ বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের সাংসদ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। এ সময় সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তার গাড়ির সব কাগজপত্রই সঠিকভাবে আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু সেসব কাগজপত্র দেখাতে না পারলে পুলিশকে এ বিষয়ে মামলা দায়ের করতে বলেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করলে তা দেখে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

বৃহস্পতিবার কারওয়ানবাজার-ফার্মগেটে সড়কে নৌপুলিশের ডিআইজির গাড়ি আটকে দেয় ছাত্ররা। গাড়িতে ‘পুলিশ’- লেখা দেখে শিক্ষার্থীরা কাগজপত্র দেখতে চাইলে গাড়িতে থাকা নৌপুলিশের ডিআইজি হাবিব কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এমনকি গাড়ির চালক তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও দেখাতে পারেননি। এ ঘটনায় উপস্থিত সকলেই বিষ্মিত হন।

এছাড়াও লাইসেন্স না থাকায় তেজগাঁও থানার পিকআপ ভ্যান আটকে দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে কাওরান বাজার এলাকা অতিক্রম করার সময় শিক্ষার্থীরা গাড়ির চালকের লাইসেন্স দেখতে চায়। তখন ড্রাইভার জানান, তার লাইসেন্স নেই। গাড়িতে অবস্থানরত এএসআই মোহাম্মদ আলী জানান, পিকআপটি তেজগাঁও থানার। ছাত্রদের কাছে গাড়ি ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানালে ছাত্ররা জানায়, মামলা না দিয়ে গাড়ি ছাড়া হবে না। এসময় ড্রাইভার পরিবর্তনের কথা বললেও ছাত্ররা গাড়ি ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি।

রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বিজিবি’র (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) গাড়ি আটক করে লাইসেন্স না থাকায় মামলা দিয়ে ছেড়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টসহ নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামেও বেশ কয়েকজন পুলিশের মটর সাইকেল থামিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেয়ে মামলা দেয়ার ব্যবস্থা করে তারপর ছেড়েছে শিক্ষার্থীরা। পুলিশ বাইক চালাচ্ছেন অথচ ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র নেই এমন বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ঘটনায় মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি অফিসের গাড়ি ব্যবহারকারীরা শিক্ষার্থীদের দেয়া এই শিক্ষা নেবেন কি না তা-ই এখন দেখার বিষয়। রাজধানীর আসাদগেটে রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের এক ছাত্রী বলছিলেন, “আমরা তো আর সারাজীবন এই ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্ব নেব না। আমরা দেখিয়ে দিতে চাই ঘুষ না খেয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করলে দেশের যানজট কমানো সম্ভব, নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দেশটা চালানো যায়।”

তবে তারা এখন পর্যন্ত কোন অ্যাম্বুলেন্স বা হজ্ব যাত্রী পরিবহনকারী গাড়ি আটকেছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীরা বরং অ্যাম্বুলেন্স এবং অসুস্থ রোগী থাকা সিএনজি বা রিক্সাগুলোকে সঙ্গ দিয়ে এগিয়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে সহযোগিতা করছে।