দেশের চাহিদা ও বিশ্বের জনশক্তি বাজার বিবেচনায় শিক্ষাক্রম ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, গুণগত মান সমুন্নত রেখে দেশের চাহিদা ও বিশ্বের জনশক্তি বাজারের কথা বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর সম্প্রসারণ করতে হবে।যুগের চাহিদা ও উপযোগিতা বিবেচনা করে নতুন নতুন বিভাগ খুলতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে।

শনিবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে আচার্যের ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন,ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে।এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের পাশাপাশি লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে।জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সবাইকে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।নেতৃত্ব ছাত্রসমাজ থেকেই গড়ে উঠতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুস্থ ও মেধাভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে বিত্তের প্রলোভনের ওপরে চিত্তকে স্থান দিতে হবে।একসময় ছাত্র রাজনীতি ছিল আদর্শনির্ভর। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করাই ছিল তার লক্ষ্য। রাজনীতি এখন হয়ে গেছে গরিবের বাউজের মতো। যে কেউ এসে ঢুকে পড়তে পারে।আমলাসহ বিভিন্ন পেশার লোক রিটায়ার করার পরে রাজনীতিতে আসছেন।এক্সপার্টদের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু যার-তার রাজনীতিতে ঢুকে পড়া বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের পথে বাধা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে।এই প্রক্রিয়াকে যাতে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সে জন্য ছাত্রসমাজকে তৎপর থাকতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে যারা রাজনীতিতে আসতে চায়, তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।

ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে যুক্ত আবদুল হামিদ সমাবর্তনে তার লিখিত বক্তব্যের বাইরে গিয়ে একথা বলেন। এসময় সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারীরা হাসিতে ফেটে পড়েন।কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার টানে তিনি বলেন,আমি যদি বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের লেকচারার হইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব আমারে নেবেন না। বা কোনো হাসপাতালে গিয়া বলি, এতদিন রাজনীতি করছি, হাসপাতালে ডাক্তারি করতে দেন। বোঝেন অবস্থাটা কী হবে? এগুলো বললে হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না।যদি বলি এত বছর রাজনীতি করছি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর পদ দিতে পার। সেখানে আমাকে দিবে? কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, সবাই… ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি ডাক্তারি পড়ি… ভিসি সাহেবও অবসরের পর রাজনীতি করবেন। যারা সরকারি চাকরি করেন… জজ সাহেব যারা আছেন ৬৭ বছর চাকরি করবেন। রিটায়ারের পর বলবেন, আমিও রাজনীতিবিদ। আর্মির জেনারেল হওয়া সেনাপ্রধান হওয়া, সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি রিটায়ার কইরা বলেন, আমি রাজনীতি করবো। কোন রাখঢাক নাই। যার ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা তখনই রাজনীতি ঢোকে…চাকরি করে যা করার করছে। এরপর বলছে রাজনীতি করবো। আমার মনে হয় সকল রাজনৈতিক দলকে এটা চিন্তা করা উচিত। হ্যাঁ এক্সপার্টের দরকার আছে। অনেক সময় বলা হয় পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট। হ্যাঁ পেশাভিত্তিক করেন। এমবিবিএস পাস করে সরাসরি রাজনীতি করেন। কোনো অসুবিধা নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরিতে না ঢুকে সরাসরি রাজনীতিতে ঢোকেন।রাষ্ট্রপতি বলেন, ৫৯ বছর, ৬৫ বছর ৬৭ বছর পুলিশের ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করবেন। মনে মনে কই, রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়ে পাছার মধ্যে বাড়ি দিছো। তুমি আবার আমার লগে আইছো রাজনীতি করতে। কই যামু।রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এই যে রাজনীতিবিদদের সমস্যা এই সমস্যার কারণও এটা। বিজনেসম্যানরা তো আছেই… শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার।ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির শিক্ষা নেওয়ার উপর জোর দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, এক্সপার্টের প্রয়োজন আছে। এক্সপারটাইজ হিসেবে তাদের মতামত নেন। তাদের কমিটি করে দেন, উপদেষ্টা করে দেন।

ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে এটা যেন কেমন কেমন লাগে। যার জন্যেই আমার মনে হয় আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না।এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে কথা বলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আবদুল হামিদ।ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার আলো দেখছি। ছাত্র সমাজের বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই। যখন তফসিল হয়, দেখা যাবে অনেক ক্যালকুলেশন হবে। ভেজাল সৃষ্টি করে দিতে পারে। অনেকে অনেক স্বার্থে করতে পারে। কিন্তু সমস্ত ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করা উচিত না। এ ব্যাপারে তৎপর থাকতে হবে। যাতে কোনোভাবে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। যারা ব্যক্তি বা অন্য স্বার্থ দেখতে চায় এদেরকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কুফলও উঠে আসে রাষ্ট্রপতির কথায়।কলেজে পড়ার সময় আমরা প্রেমপত্র লিখছি। ভালো কোটেশন কিভাবে চিঠিতে দিলে সুন্দর হবে। এখন তো চিঠি লেখাই একেবারে নাই। এখনতো মেসেজ পাঠায়। ইংরেজিতে বাংলা লেখে। কী লেখে? ফেইসবুক-টেইসবুক এসব আমি বুঝি না। আমি ব্যাকডেটেড।রসিকতা করে তিনি বলেন, আপনারা যে প্রেমপত্রকে বিসর্জন দিছেন। প্রেমের সাহিত্য তো মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে যাচ্ছে। প্রেমপত্র লেখার চর্চাটা অন্তত রাখেন। তাহলে প্রেমপত্রে সাহিত্য বেঁচে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। ছোটবাচ্চাদের মোবাইল দিয়ে বসায়া রাখে। এইটাও চিন্তা-ভাবনার বিষয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। ট্রেনে-বাসে উঠলে পাশের যাত্রীকে বলতাম কোথায় যাবে। এখন কোনো কথাই নেই। বইয়াই মোবাইল টিপ দিয়া দেয়। তুই ব্যাটা জাহান্নামে যা, আমি আছি মোবাইল আছে। এই যে অবস্থা। আমার মনে হয় সামাজিক বন্ধন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ের মতো স্ত্রী রাশিদা খানমের সঙ্গে নিজের খুনসুটির কথাও তুলে ধরেন আবদুল হামিদ। দেশের প্রয়োজনে এবং জাতীয় স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানান আবদুল হামিদ।সমাবর্তন বক্তৃতায় জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, শিক্ষাব্যবস্থাটা হওয়া উচিত পিরামিডের মতো; এর ভিত্তিটা চওড়া হবে, উচ্চশিক্ষা হবে তার চূড়া। সবাই যাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে পারে, সর্বাগ্রে তা দেখা দরকার। গ্র্যাজুয়েটদের কাছে আমার একটাই নিবেদন, তোমরা ভুলে যেয়ো না, তোমাদের আজকের কৃতিত্বের মূলে আছে তোমাদের পরিবার, তোমাদের শিক্ষায়তন, তোমাদের এই গরিব দেশ। যেখানে যে অবস্থায়ই থাকো, পরিবার ও দেশের কাছে তোমাদের ঋণের কথা ভুলে যেয়ো না।সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন ফোরামে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নানা কারণে প্রায় তিন যুগ ধরে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। রাজনীতিমনস্ক গ্র্যাজুয়েট তৈরি ও ভবিষ্যত জাতীয় নেতৃত্বের বিকাশে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অত্যাবশ্যক। যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ নির্বাচন আয়োজনে আমরা বদ্ধপরিকর।এ লক্ষ্যে ভোটার তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য ১৬ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদকে সচল করা হয়েছে।এবারের সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েট অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের গ্র্যাজুয়েটরা প্রথমবারের মতো সমাবর্তনে অংশ নেন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য ৯৬ জন কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে স্বর্ণপদক, ৮১ জনকে পিএইচডি ও ২৭ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়।