বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সর্বস্তরের মানুষ প্রিয় শিল্পী মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়।সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুর ১টার দিকে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নিয়েও যাওয়া হবে হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠে। সেখানে বাদ জুমা তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।পরে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মগবাজারে তার নিজের স্টুডিও এবি কিচেনে। আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় জানাজা হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। দ্বিতীয় জানাজা শেষে শিল্পীর মরদেহ হিমঘরে রাখা হবে।অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে আইয়ুব বাচ্চুর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। তারা এলে চট্টগ্রামে শনিবার মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু।শহীদ মিনারে বিমর্ষ চিত্তে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের কাপড়ের দোকানের কর্মী অনিক।আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দীর্ঘ সারিতে এই ব্যান্ডতারকার যে ভক্ত-অনুরাগীরা ছিলেন, তার একজন ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ।আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর অনিক বৃহস্পতিবার শোনেন দোকান থেকে ফেরার পর রাতে।

অনিক বলেন, আমি দোকান থেকে আসার পর খবর শুনে তো কান্না থামাইতে পারতেছিলাম না।কিছুদিন আগেও মুসলিম স্কুলের মাঠে বসের কনসার্টে গেছিলাম। আমি ছবিও তুলছিলাম উনার সাথে। উনার এভাবে চলে যাওয়া আমি মানতে পারছি না।অনিকের মতোই একগুচ্ছ গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন মীনাবাজারের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট শাখায় কাজ করা কৌশিক; আইয়ুব বাচ্চুর ছবি সম্বলিত কালো টিশার্ট ছিল তার গায়ে।তিনি বলেন, আইয়ুব বাচ্চু তিন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়। আমার আম্মু উনার গান পছন্দ করে, আমি করি এবং আমার মেয়েও করে। উনার প্রস্থান আমাদের জন্য বিশাল ধাক্কা।আমাদের প্রজন্ম উনার কাছে অনেক কিছু পেয়েছি কিন্তু আমার মেয়েটা পেলো না। এটা আসলেই বিশাল একটা ধাক্কা। বস, যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক, এই দোয়া করি।

বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতাঙ্গনে গিটারের জাদুঘর হিসেবে খ্যাত আইয়ুব বাচ্চু হার্ট অ্যাটাক করে বৃহস্পতিবার মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও প্লেব্যাক শিল্পী। চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই।শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চুর ভক্ত, অনুরাগীসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও শামিল ছিলেন।শ্রদ্ধা জানাতে এসে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ অনেকে যেমন চোখের জলে ভেসেছেন, তেমনি শোকসন্তপ্ত হয়ে তার সৃষ্টিকে স্মরণ করেছেন ভক্ত-অনুরাগীরা।আজীবন কেবল সঙ্গীত সাধনায় আইয়ুব বাচ্চুর মেতে থাকার কথাও বারবার ফিরে এসেছে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা নানা মানুষের কথায়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ব্যান্ড সঙ্গীতকে তিনি এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম তার দেখানো পথে চলে নবচেতনায় উজ্জীবিত হবে।আইয়ুব বাচ্চুর অকালে চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, আমরা জানি প্রতিটি কনসার্ট তিনি জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করতেন।আইয়ুব বাচ্চুর সহশিল্পীসহ সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন জনের কথাও তরুণদের উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা ফুটে উঠে। জ্যেষ্ঠ এই শিল্পীর স্মৃতিচারণ করে শিরোনামহীন ব্র্যান্ডের সাবেক ভোকাল তানযীর তুহিন বলেন, বাচ্চু ভাই আমাদের চেয়ে বড় হলেও সবসময় তরুণই ছিলেন। অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তিনি ব্র্যান্ড মিউজিক করতেন। আমরা যেন সেটা ধরেই বেঁচে থাকি।ব্যান্ডদল ফিডব্যাকের ফুয়াদ নাসের বাবু বলেন, গানের জন্য তার পরিশ্রম, সাধনা ও প্যাশন ছিল সার্বক্ষণিক। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে একজন আইয়ুব বাচ্চু।

গিটারের অবিরাম সুরের মূর্ছনায় আইয়ুব বাচ্চু ভক্তদের যেভাবে মাতিয়ে তুলতেন, সে প্রসঙ্গও উঠে আসে এই মিউজিশিয়ানের কথায়।উনার গিটার বাজানো দেখে দেশের হাজার হাজার তরুণ গিটার বাজাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, গিটার বাজানো শিখেছে।১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো কেটেছে সেখানেই।এক সাক্ষাৎকারে বাচ্চু বলেছিলেন, ছেলে বেলায় গান শুনতে শুনতে নিজে চেষ্টা করতে গিয়েই তার গায়ক হয়ে ওঠা। পশ্চিমা সংগীতের প্রেমে পড়ে হাত দেন গিটারে। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুরের মত শিল্পীদের কাজ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা।

কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় আগলি বয়েজ। পাড়া মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের পরিবেশনা।পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৮ সালে। ব্যান্ড দলে ‘ফিলিংস’ এর সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি। দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে।টানা ১০ বছর সোলসের লিড গিটার বাজানোর পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’।আইয়ুব বাচ্চুর কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কান্নাভেজা চোখে বিষণ্ন মনে শহীদ মিনার এলাকায় হাঁটছিলেন জনপ্রিয় অনেক গান ও জিঙ্গেলের শিল্পী সুমনা হক।

প্রথমে কয়েকজন সাংবাদিক কথা বলতে চাইলেও শোকাহত এই শিল্পী এড়িয়ে যান। কিছুক্ষণ পর কিছুটা শোক কাটিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতিচারণ করেন তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাজ করা এই শিল্পী।সুমনা হক বলেন, আশির দশক থেকে ওনার সঙ্গে কাজ করেছি। কত কত স্মৃতি! সবগুলো এখন একে একে হৃদয়ে বাজছে। সঙ্গীত সাধনা ও জনপ্রিয়তার চূড়ায় থাকাবস্থায় তিনি চলে গেছেন। এই যে হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা জানাতে তাদের উপস্থিতি এটাই তার বড় প্রাপ্তি।শিল্পী রবি চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, সাফিন আহমেদ, নকিব খান, নাসিম আলী খান, তপন চৌধুরীদের মতো সতীর্থদের সামনে রাখা কফিনে সার বেঁধে শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব চলে।বাচ্চুর চট্টগ্রামের দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন সেখানে তার সঙ্গে কাজ করা ব্যান্ডশিল্পী নাসিম আলী খান।

তিনি বলেন, বাচ্চু আমাদের ছোটবেলার বন্ধু। আমরা চট্টগ্রামে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সঙ্গীতের চর্চা শুরু করি। আমার প্রথম অ্যালবামের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। তার সঙ্গীত চর্চা তরুণ প্রজন্মের মাধ্যমে আজীন জাগরূক থাকুক।শিল্পী তপন চৌধুরী বলেন, এখানে এসে আবার বুঝেছি, বাচ্চুর জন্য এত মানুষ পাগল! এটা একটা মানুষের অনেক বড় পাওনা। তার আত্মা শান্তি পাক।

শিল্পী রবি চৌধুরী বলেন, কিছু বলতে আসিনি। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। বাচ্চু আমার চট্টগ্রামের বন্ধু। বাচ্চু তার কর্ম দিয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে উপ-উপাচার্য কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, সঙ্গীতের যে নতুন ধারা ব্যান্ড সঙ্গীত সেখানে আইয়ুব বাচ্চু উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার সঙ্গীত গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ত, মানুষের জন্য তিনি গান গেয়েছেন। আমি যতটুকু জানি কনসার্ট শেষ করার আগে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাইতেন। এ থেকেই বোঝা যায় দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো অগাধ।

সকাল সাড়ে ১০টায় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দুই ঘণ্টা পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় ঈদগাহে ।বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম নামাজে জানাজা হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠে সম্পন্ন হয়েছে।শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) শহীদ মিনার থেকে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। তারপরই দুপুর পৌনে ১টার দিকে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তার মরদেহ আনা হয়। আইয়ুব বাচ্চুর জানাজায় শিল্পী,নাট্যকার, রাজনীতিবিদ, আইনজীবীসহ সর্বস্তরের লাখো মানুষ অংশ নেন।জানাজায় আইয়ুব বাচ্চুর ছোট ভাই এরফান চৌধুরী বলেন, আইয়ুব বাচ্চু সব সময় মানুষকে সাহায্য করতেন। সাধারণ মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। পরিবারের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিলো। সবাই আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন।আইয়ুব বাচ্চুর জানাজার নামাজ পড়ান হাইকোর্ট মসজিদের ইমাম আবু সালেহ সাইফুল্লাহ। জানাজায় শিল্পী ফকির আলমগীর, নকীব খান, বিপ্লব, কবির বকুল, অন্তর শো বিজের পরিচালক স্বপন চৌধুরী প্রমুখ অংশ নেন। জানাজা অনুষ্ঠানের আগে ভক্তদের ভিড়ের কারণে আইন-শৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেগ পেতে হয়। জানাজার লাইনে দাঁড়ানোর জন্য বার বার অনুরোধ জানানো হয়। তবে ভক্তরা বাচ্চুর মরদেহের গাড়ির কাছে ভিড় করতে থাকে। পরে সঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর সবাইকে অনুরোধ করেন। আইয়ুব বাচ্চুর ছোট ভাই এরফানে চৌধুরীও ভক্তদের গাড়ির কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সে কারণে জানাজা সম্পন্ন হতে দেরি হয়।

জানাজা শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মগবাজারে তার নিজের স্টুডিও এবি কিচেনে। আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় জানাজা হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। দ্বিতীয় জানাজা শেষে শিল্পীর মরদেহ হিমঘরে রাখা হবে।আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ শুক্রবার চট্টগ্রামে নেওয়া হবে। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে আইয়ুব বাচ্চুর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। তারা এলে চট্টগ্রামে শনিবার (২০ অক্টোবর) জানাজা শেষে মায়ের কবরের পাশে চিরন্দ্রিায় শায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু।বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) মাত্র ৫৬ বছর বয়সে আইয়ুব বাচ্চু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জনপ্রিয় এই শিল্পীর মৃত্যুতে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড এলআরবির দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারবাদক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক।