বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে মঙ্গলবারেও গাজীপুরে বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও ভাংচুর করেছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশের মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছে। এসময় একাধিক পয়েন্টে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশসহ অন্ততঃ ১৮ জন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ সর্টগানের গুলি ও টিয়ার সেল ছুড়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে এদিনও কয়েকটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ভ্রান্ত ধারণা থেকে শ্রমিকরা অযৌক্তিকভাবে এ আন্দোলন করছে বলে পুলিশ ও কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবী করেছে।

পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, সরকার ঘোষিত মুজুরী কাঠামো অনুযায়ী বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবি মঙ্গলবারেও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। এদিন ওই দাবীতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ঢাকা বাইপাস সড়কের ভোগড়া পেয়ারাবাগান এলাকার ভি এন্ড আর ফ্যাশন্স পোশাক কারখানার অপারেটর ও শ্রমিকরা দুপুরে খাবারের বিরতির পর কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। গত কয়েকদিন ধরে তারা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এতে সাড়া না দেওয়ায় শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী ভোগড়া পেয়ারাবাগান এলাকায় ঢাকা বাইপাস সড়কের উপর অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। তাদের সঙ্গে বহিরাগত শ্রমিকরাও অংশ নিয়ে আশেপাশের বিভিন্ন কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়ে ভাংচুর শুরু করে। এসময় আন্দোলনরত শ্রমিকরা একটি মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করে এবং অপর একটি সড়কের পার্শ্ববর্তী খাদে ফেলে দেয়। এসময় তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তারা আশেপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের আহবান জানায়। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে পার্শ্ববর্তী চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার টিএন ফ্যাশন, ব্রাদার ফ্যাশন, এ্যাপারেলস গার্মেন্টসসহ ভোগড়া, বাসন সড়ক, মালেকের বাড়ি বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে সড়কে নেমে এসে সড়ক অবরোধ করে। তারা বিভিন্ন কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে দরজা জানালার কাঁচসহ বিভিন্ন মালামাল ভাংচুর করতে থাকে। মহাসড়ক অবরোধের কারণে যানবাহন আটকা পড়ে উভয়দিকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ মালেকেরবাড়ি কলম্বিয়া এলাকায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরে যেতে বললে তারা না মেনে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে পুলিশের তিন সদস্যসহ অন্ততঃ ১০ জন আহত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ বিভিন্ন পয়েন্টে টিয়ার সেল ও সর্টগানের গুলি ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বাসন থানার ওসি মুক্তার হোসেন জানান, বিক্ষোভ চলাকালে উত্তেজিত শ্রমিকরা বাসন থানার ওসি (অপারেশন) নন্দলালের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

ভি এন্ড আর ফ্যাশন্স পোশাক কারখানার কর্মী সোহেল জানান, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম বেতন ৮হাজার টাকা হেলপারদের দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই হারে অপারেটরদের বেতন বৃদ্ধি করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন যাবৎ অপরেটররা তাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি মানছে না। তাই অপারেটররা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর আনিছুর রহমান ও আমজাদ হোসেন জানান, শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এসময় পুলিশের তিন সদস্য আহত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ টিয়ার সেল ও সর্টগানের গুলি ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। প্রায় এক ঘন্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হলে বিকেল ৩টার দিকে যানচলাচল শুরু হয়। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে এদিন কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এদিকে এদিন একই দাবীতে মহানগরের কোনাবাড়ি, জরুন ও কাশিমপুর এলাকার আলিফ গার্মেন্টস, স্বাধীন ও স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসসহ বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিকেল হতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। এসময় তারা সড়ক অবরোধ করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে বিভিন্ন পয়েন্টে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। সন্ধ্যার পর পর্যন্ত এ সংঘর্ষ অব্যহত থাকে। এতে পুলিশসহ অন্ততঃ ৮ জন আহত হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে একাধিক পয়েন্টে টিয়ার সেল ও সর্টগানের গুলি ছুড়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তারা জানান, কারখানার কর্তৃপক্ষ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বেতন ভাতা শ্রমিকদের দিচ্ছে। কিন্তু বহিরাগত কিছু শ্রমিক বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের জোরপূর্বক কারখানা থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে সড়কে গন্ডগোল করেছে। ভুল ধারণা থেকে শ্রমিকরা অযৌক্তিকভাবে এ আন্দোলন করছে। সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামোয় পোশাক কারখানার সিনিয়র-জুনিয়র অপারেটরদের মূল বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খাতের ভাতাদি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের আগের ঘোষিত গেজেটে কর্মীদের দক্ষতা অনুযায়ী তাদের গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে বেতন ভাতা কম দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। বেতনের টাকা হাতে পেলেই শ্রমিকদের ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বিভিন্ন মহল সিনিয়র অপারেটরদের ভাতাদি বৃদ্ধি করা হয়নি বলে গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনে ইন্দন দেয়। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে তারা অযৌক্তিকভাবে বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবীতে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ ও আন্দোলন করে ভাংচুর করে আসছে। শ্রমিক অসন্তোষ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারখানা দেখা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে কয়েকটি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব কারখানা খুলে দেওয়া হবে।

গাজীপুরের শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহেব আলী পাঠান জানান, সরকার ঘোষিত মুজুরী কাঠামো অনুযায়ী বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গাজীপুরের ইতোমধ্যে কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কারখানা বন্ধ থাকার কথা ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।