’ধন্যতুমি, পূণ্যতুমি আন্তনী, মহাজ্ঞানী, মহাত্যাগী সাধু আন্তনী’- এ বন্দনার মধ্যদিয়ে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের উপস্থিতিতে শুক্রবার কালিগঞ্জের পানজোরা গ্রামে অনুষ্ঠিত হলো খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম সাধু আন্তনীর তীর্থোৎসব। বৃদ্ধ হতে শিশু পর্যন্ত মহান সাধক আন্তনীর দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক ভক্ত তীর্থোৎসবে যোগ দিয়েছেন।

রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের প্রাচীন গ্রাম পানজোরা খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকা। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও পানজোরার রয়েছে নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য। শুক্রবার এ গ্রামটি প্রায় অর্ধলাখ বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ও শিশুদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারক যাজক সাধু আন্তনীর পার্বন উপলক্ষ্যে শুক্রবারের এ তীর্থোৎসবে সাধু আন্তনীর ভক্তদের বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী ছাড়াও এ সমাবেশে হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের মানুষ ভীড় জমিয়েছিল। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী ৫০ হাজারেরও বেশী তীর্থ যাত্রী এবারের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন তীর্থোৎসব উপলক্ষ্যে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও টহল পুলিশ ছাড়াও অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ পথে পুলিশ প্রহরা ছাড়াও আন্তনী পার্বন কমিটির নিজেদের দেড় শতাধিক নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করছিল নিরাপত্তার জন্য।

পাদুয়ার সাধু আন্তনী ‘পৃথিবীর সাধু’ হিসেবে পরিচিত। সর্বজন প্রিয় এই সাধু আন্তনী ছিলেন ঐশজ্ঞানের আঁধার, মঙ্গলসমাচারের সুদক্ষ প্রচারক, নিঃস্ব অসহায় মানুষের বন্ধু, পাপীর মন পরিবর্তন, রোগীদের সুস্থ্যতাকারী বহুগুণে গুনান্বিত এক মহান সিদ্ধ পুরুষ। খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে বার্ষিক এ সমাবেশের গুরুত্ব অনেক। সাধু আন্তনীকে ঘিরে এলাকায় নানা কিংবদন্তীর কথা শোনা যায়। ভক্তদের অনেকের মতে সাধু আন্তনী ছিলেন মঙ্গল বিধায়ক। তিনি ছিলেন অলৌকিক কর্মসাধক, দাতা, ত্যাগী ও মঙ্গলবিধায়ক। তিনি মানুষের অসাধ্য আশা-আকাংখা পুরণ করেন। তার কাছে মানুষ যা চায় ঈশ্বরের কৃপায় তাই তিনি দান করেন।

সাধু আন্তনীর স্মরণে গত ২৩ জানুয়ারি হতে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত নয় দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় নভেনা অর্থাৎ আধ্যাতিœক প্রস্তুতির খ্রীষ্টযাগ। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে এ খ্রীষ্টযাগ অনুষ্ঠিত হয়। দশমদিন অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি শেষদিনে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় আন্তনীর পার্বন। এ দিন ভোর হতে দুপুর পর্যন্ত দু’বার খ্রীষ্টযাগ অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ভক্তরা পার্বণের তিনদিন আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যা হতে পরদিন বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত উপবাস করেন। উপবাস শেষে তারা এদিন নিরামিষ ও শাক-সব্জি ভোজনের মাধ্যমে নিজেদের ভক্তি প্রদর্শন করেন। ফুলদিয়ে সু-সজ্জিত মঞ্চের সামনে বর্ণাঢ্য সাজের পোশাকের ছেলে মেয়েরা ’জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ——’, ‘তাঁরই জয়গানে মুখর ধরণী’ গানের সঙ্গে নৃত্যের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করে। এরপর সুশৃংখল দু’সারিতে শ্বেতশুভ্র সাদা পোশাকে সুসজ্জিত শিশু আর সিস্টাররা ধুপ পুড়িয়ে মোমবাতি হাতে নিয়ে ’হে মহাজ্ঞানী, হে মহাত্যাগী স্বাগতম সাধু আন্তনী’ কোরাস গেয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে। তাদের পেছনে পোর্টেবল রঙ্গীন সামিয়ানার নীচে ফাদারদের দল শোভাযাত্রাসহ হেটে আসে। শোভা যাত্রায় সবার পেছনে আসেন আর্চবিশপ। প্রতিবারের খ্রীষ্টযাগের আগে এ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এভাবে একের পর এক নানা বর্ণিল আয়োজন, সঙ্গীতের মাধ্যমে আন্তনীর বন্দনা করা হয়। সুশৃংখল উপস্থানপনার কারণে পুরো সামবেশ স্থলে সৃষ্টি হয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ। ভক্তমন্ডলীর উদ্দেশ্যে খ্রীষ্ট ধর্ম, যীশু আর আন্তনীর লক্ষ্য আদর্শ নিয়ে আলোচনা করা হয়। শুক্রবার দু’টি পর্বের তীর্থোৎসব প্রথম পর্ব সকাল সাড়ে ৭টায় ও দ্বিতীয় পর্ব সকাল সাড়ে ১০টায় আরতি আগমনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। পরস্পর আরতি শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর শুরু হয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বানী পাঠ ও উপদেশ।

পানজোরা ধর্ম পল্লীর ফাদার (পাল পূরোহিত) জয়ন্ত এস গমেজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শুক্রবার সকাল ৭টায় প্রথম প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন সহকারী বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ। প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী এ খ্রীষ্টযাগ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ও শেষ খ্রীষ্টযাগ। তারপর প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন প্রথম বাঙ্গালী কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। প্রার্থনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণ কামনা করা হয়। হিংসা, হানাহানি ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ভাবগম্ভীর পরিবেশে প্রার্থনায় উপস্থিত ভক্তবৃন্দ অংশেনেন। প্রার্থনা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। দশ দিনের অনুষ্ঠান শেষে দেশে শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে কবুতর উড়ানো হয়।

তীর্থোৎসবের দুই পর্বের প্রার্থনা সভার দ্বিতীয় পর্বে এদিন অংশ নেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি এবং ভ্যাটিক্যান, ফ্রান্স ও ইতালীর রাষ্ট্রদূতগণ, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা করেন। এছাড়াও ভারত, আমেরিকা, ইতালি সহ বিশ্বের অন্ততঃ ১২টি দেশের খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বিরা এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মহান এ তীর্থোৎসব উপলক্ষ্যে দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা স্বামী-স্ত্রী-সন্তানসহ তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে গত কয়েকদিন থেকেই গাড়ী ও ট্রেন যোগে পানজোরাতে আসতে থাকেন। ফলে পুরো এলাকা উৎসব মুখর হয়ে উঠে। বিপুল সংখ্যক লোকসমাগমের কারণে তীর্থস্থান সহ আশেপাশের এলাকায় হরেক রকম পণ্যের মেলা ও দোকান বসে। শুক্রবার ভোর হতে তীর্থযাত্রীগণ প্যান্ডেলের নীচে ও আশে পাশের এলাকায় ভীড় জমাতে থাকে। এসময় অনেক ভক্ত তাদের মানত পূরন হওয়ায় সাধু আন্তনীর চরণে টাকা, মোমবাতি, কবুতর, মুরগি ইত্যাদি দান করেন। মহান সাধু আন্তনীর ইচ্ছায় অসুস্থতা থেকে আরোগ্যলাভ করায় অনেকেই আতœীয়-স্বজনের সার্বিক মঙ্গলের জন্য এবং তাদের আশা পূর্ন হওয়ার জন্য কালীগঞ্জে শুক্রবারের পার্বনে আসেন এবং প্রার্থনা করেন। তাদের মতে এখানে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই মনের আশা পূর্ণতা লাভের আশায় মহান সাধকের কাছে প্রার্থনা জানাতে আসেন।

ইতিহাস ॥ গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার এই এলাকটি শত শত বছর আগে থেকেই খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত। ভাওয়াল গড়ের অংশ এলাকাটিতে ছোট ছোট টিলার ওপর বাড়ি-ঘর। বেশির ভাগ ঘর অপূর্ব সুন্দর সৌকর্যের মাটির দেয়ালের। এ গ্রামেই আছে সাধু আন্তনীর গীর্জা। তবে এ গ্রামে তার চেয়েও পুরনো গির্জার নাম সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনু চার্চ। পর্তুগীজ ফাদাররা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। সাধু আন্তনীর জম্মও পর্তুগালের লিসবন শহরে, ১১৯৫ সালে। যিশুর মতো আন্তনীর মায়ের নামও মেরী। খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন আন্তনীও যিশুর মতো অলৌকিক সব কাজ করতে পারতেন। সাধু আন্তনী পানজোরা আসেননি। তবে এ গ্রামে তাঁর নামে গির্জা প্রতিষ্ঠার পিছনেও রয়েছে কিংবদন্তীর কাহিনী। আন্তনীর কাছে চাইলে ঈশ্বর অসাধ্য অনেক কিছুই মজ্ঞুর করেন। এলাকটি এক সময় ছিল গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে গাঁয়ে আস্তানা প্রতিষ্ঠার পর এক পর্তুগীজ ফাদার প্রায় রাতে কান্নার শব্দ শুনতে পেতেন জঙ্গলে। রহস্যময় সেই শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে জঙ্গলের ভিতর একটি বট গাছের নিচে পাওয়া যায় সাধু আন্তনীর একটি মূর্তি। সেখানে সেই মূর্তিটির একটি জায়গা করে দেবার জন্য ফাদার স্বপ্নাদিষ্ট হন । এলাকার নিঃসন্তান এক বিত্তশালী মহিলা সব কিছু শুনে তাঁর সমস্ত ভূ-সম্পত্তি দান করেন সাধু আন্তনীর আরাধনা আশ্রম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। ধর্মান্তরিত হয়ে মহিলা নাম নেন ক্যাথরিন। সেই ক্যাথরিন বিবির দান করা সম্পত্তিতে আজ পর্তুগীজ স্থাপত্যবিদদের তৈরি অন্যন্য সুন্দর এক গির্জা ছাড়াও আবাসিক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষ তীর্থস্থানের জন্য ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন বলে জানা গেছে। আর আন্তনীর তীর্থোৎসব উপলক্ষ্য পার্বণটি হয়ে উঠেছে দেশের খ্রীষ্ট ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় মিলন মেলা।