জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করেছে বাঙালি জাতি। পয়লা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতে উঠেছে পুরো দেশ।

বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। নানা রূপ, নানা সুষমায় প্রাণোচ্ছ্বলতায় প্রতিটি দিনকে তারা বরণ করে নেয় অনাবিল পূর্ণতায়। বিশালতার মায়ায় ভালোবাসার বাঁধন এখানে মুক্ত, উদার, পঙ্কিলতা বিবর্জিত ও স্নিগ্ধ। তারা দুঃখ, জরা, ক্লেশকে জয় করতে জানে, জানে শত কষ্টে পিষ্ট হৃদয় নিয়েও স্বপ্নের বিশালতায় ভাসতে।

দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনৃষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

সকালে ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেয় নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। রাজধানী জুড়ে বর্ষবরণের নানা আয়োজন।কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।

১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।

শিল্প সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ উৎসবমুখর বাঙালি বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে ঘিরে থাকে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে। চিরচেনা বাঙালি জাতির এই নতুন বছরকে সাজ সাজ রবে বরণ করার উৎসবটি বাঙালিয়ানার মূল ঐতিহ্যের অন্যতম। তাই নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি শুরু হয় বেশ কয়েকমাস আগেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্পন্ন হয় নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি। প্রতি বছরই দিনটি শুরু হয় প্রভাতবেলায় সার্বজনীন মঙ্গল কামনা করে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে অবগাহনের পাথেয় হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে।

উৎসবে মতোয়ারা তরুণীরোববার (১৪ এপ্রিল) ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো …সুরের তালে তালে নববর্ষকে বরণ করে নেয়। বর্ষবরণের ঢেউ লাগে এদেশের কোটি বাঙালির মানসপটে। এরপরেই বর্ষবরণের মূল আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চারুকলা অনুষদমুখী ভিড় বাড়তে থাকে। ৯টা বাজতেই শাহবাগ থেকে টিএসসি এলাকা বৈশাখের রঙে রঙিন মানুষের পদভারে ভরে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেম গোলাম রব্বানী চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের নেতৃত্বে চারুকলা থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি শাহবাগ, ঢাকা ক্লাব হয়ে টিএসসি হয়ে আবার চারুকলায় গিয়ে শেষ হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিদেশি অতিথিএবার শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য করা হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ৪৮ নম্বর কবিতার ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’ চরণ। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের ভাষায় বর্তমানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরও নানা ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সে জন্যই এবারের শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে অনুপ্রেরণার উৎসব সন্ধান করা হচ্ছে।

উচ্ছ্বসিত তরুণীশোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। সবাই বৈশাখের বিচিত্র সাজে নিজেদের রাঙিয়েছেন। মুখে রং তুলিতে লেখা শুভ নববর্ষ ১৪২৬, এসো হে বৈশাখ। ছেলেরা লাল-সাদা পাঞ্জাবি, মেয়েরা বৈশাখী শাড়ি পরেছেন। অনেকে মাথায় গামছা, আর লুঙ্গি পরে নিজেকে পুরো বাঙালিয়ানা সাজে সাজিয়েছেন। ছোট শিশুরাও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বৈশাখ উদযাপনে। বাঁশি, একতারা, খেলনার ঢোল হাতে নিয়ে উল্লাস করেছেন। এছাড়া অংশ নিতে দেখা গেছে অনেক বিদেশি পর্যটক-সাংবাদিককে।

উৎসবে জরুরি নিরাপত্তাবরাবরের মতো শোভাযাত্রা ঘিরে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চার স্তরের নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে। র‌্যালির সামনে পিছনে বিপুল সংখ্যক র‌্যাব সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। শোভাযাত্রায় সারি করে বাঘ, ঘোড়া, উল্টা কলসি, পেঁচা, কাঠঠোকরা এবং বাঘ ও বকের প্রতিকৃতি সাজানো ছিল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন শুধু আমাদের জাতীয় উৎসব নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এর একটি সম্মোহনি শক্তি আছে। মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের এটি একটি পথ। সেকারণে শোভাযাত্রা সব সময় চলমান থাকবে।

কথা বলছেন ঢাবি উপাচার্য অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ বর্ষবরণের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সকালে বটতলায় সঙ্গীত বিভাগ বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কলা অনুষদের সামনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ খেলাঘর আয়োজন করে শিশুদের বৈশাখী উৎসব। সাংস্কৃতিক শিক্ষায় ডানা মেলুক শিকড় শিরোনামে নাটমন্ডলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমার স্টাডিজ বিভাগ ও উত্তরণ ফাউন্ডেশন আয়োজন করে বৈশাখের অনুষ্ঠান। খৈ-মুড়ি-পান্তা ভোজের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন পান্তা-পুঁটি, ইলিশের আয়োজন করে।