সম্প্রতি দেশে বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়মের সংবাদ, ব্যঙ্গচিত্র বা আলোকচিত্র কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত বা ভিন্নমত প্রকাশের জেরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ করে লেখক-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা, হুমকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ কথা বলেন।
স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় স্বেচ্ছাচারিতার পথ পরিহার করে অবিলম্বে এ ধরনের অগণতান্ত্রিক হয়রানি বন্ধ করে আটকদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে- বিশেষ করে চলমান করোনা মহামারিতে সেবাপ্রদান, ত্রাণ বিতরণ ও নানা বিষয়ে অনিয়মের সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশ, তথ্যপ্রচার, মতপ্রকাশ, এমনকি কার্টুন প্রকাশের কারণে নানা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগে সারাদেশে সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, কার্টুনিস্ট, সমাজকর্মী, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক হামলা, মামলা, চাকরিচ্যুতি ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথাকথিত ‘গুজব ছড়ানো’, ‘মিথ্যা তথ্যপ্রকাশ’, ‘সরকারের সমালোচনা’, ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া’, ‘হত্যার হুমকি’, ‘মানহানি’ইত্যাদি যুক্তিতে নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রকাশ এবং জানার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, যা নিবর্তনমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী।’

‘অনেককেই অন্যায্য মামলায় নিগৃহীত করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে, যা শুধু স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য হুমকি নয় বরং দেশে স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলতে চাই, আপনারা কাজ দিয়ে সমালোচনার জবাব দিন, প্রকাশিত তথ্যের গুরুত্ব দিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করুন। তথ্যপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে বা ভিন্নমত দমন করে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারিতার পথে হাঁটবেন না। অবিলম্বে এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নিবর্তনমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং অন্যায্যভাবে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে নির্মোহ ও যথাযথ তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’

সম্প্রতি নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের অন্তর্ধান রহস্যের উদাহরণ টেনে ড. জামান বলেন, ‘দুর্নীতি-অনিয়মের বিভিন্ন তথ্যপ্রকাশ কিংবা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের আচরণ একদিকে যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শুন্য সহনশীলতা’ ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক তেমনি স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার পরিপন্থী। বিশেষ করে, স্বাধীন মত বা সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করাটাই যেখানে নিবর্তনমূলক, সেখানে এ ধরনের মামলার সূত্রে আটককৃতদের নিগৃহীত করা নাগরিক অধিকারের চূড়ান্ত অবমাননা। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তথ্যপ্রকাশকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে প্রকাশিত তথ্য যাচাইপূর্বক অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তা না করে উল্টো তথ্যপ্রকাশকারীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ায় প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয় যে, রাষ্ট্র কী তবে অনিয়ম, দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটনে নিরুৎসাহিত করছে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে নাকি দুর্নীতির বিচারহীনতা নিশ্চিতের প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে!’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও আটকের কঠোর সমালোচনা করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘রাষ্ট্রের উচিৎ ছিল এমন পরিবেশ তৈরি করা- যাতে গণমাধ্যম স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে তথ্যপ্রকাশ করতে পারে। কারণ তথ্যের স্বাভাবিক প্রকাশ বা প্রবাহে ঘাটতি পড়লে গুজব ও আস্থাহীনতার বিকাশ ঘটবেই। বাস্তব তথ্যের সাথে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রকাশিত তথ্যের যত বেশি ফারাক হবে, তত বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি হবে, সংকট বাড়বে এবং ভুল পরিকল্পনার আত্মঘাতী ঝুঁকি তৈরি হবে। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তার অজুহাত তুলে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশের প্রতিবন্ধক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গণমাধ্যমসহ নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপের মুখে রেখেছে। তাই অবিলম্বে এই আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল করতে হবে এবং দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্যপ্রকাশকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে ইতোমধ্যে আটকদের মুক্তি দিতে হবে।’

বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সারা দেশের ১৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৯ সালেই ৩৮ জন সাংবাদিক মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মোট ৬৭টি মামলার মধ্যে ৩৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে কার্টুনিস্ট, সাংবাদিকসহ ৭৯টি ঘটনায় মোট ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব মামলায় সাংবাদিকসহ অন্যান্য নাগরিকদের যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়েছে, তা একটি গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে ভূলুণ্ঠিত করে স্বেচ্ছাচারিতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের শামিল বলে মনে করে টিআইবি।