অফিসে প্রকাশ্যে ধূমপান, এডমিট কার্ড আটকিয়ে রেখে টাকা আদায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হুমকি ও হয়রানি, শিক্ষার্থীদের জঙ্গী-শিবির বলে গালিগালাজ ও হয়রানি, উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ উঠেছে বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার মাতৃভাষা ডিগ্রী কলেজের পৌরনীতি ও সুশাসন বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অলিউর রহমানের বিরুদ্ধে।

তিনি বাগেরহাট-৪ আসনের সাবেক এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেনের দুঃসম্পর্কের নাত-জামাই। ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অলিউর রহমান। দায়িত্বপালনকালীন সময়ে কলেজকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে প্রায় কোটি টাকার মতো অর্থের মালিক হয়েছেন এবং কলেজের বিভিন্ন খাতের অর্থ ও এমপি মহোদয়ের বিভিন্ন অনুদানের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষার্থীদের-জঙ্গী শিবির বলে গালাগালি ও হয়রানি: জানা গেছে, যেসকল শিক্ষার্থী দাঁড়ি রাখে বা টুপি পড়ে ক্লাস করে তাদের তিনি প্রায়ই জঙ্গী এবং শিবির বলে গালি দেন। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত না থাকা সত্ত্বেও এক শিক্ষার্থীকে জেএমবির সদস্য ট্যাগ দিয়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করান। এছাড়া যেসকল শিক্ষকের জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫-১০ বছর পর তারাও যদি ঐ সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তাদেরকে তিনি রাজাকার বলে গালি দেন।

শিক্ষকদের ভয়ভীতি ও হুমকি: ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপালনকালীন সময়ে অলিউর রহমান কলেজের শিক্ষকদের সবসময় ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করতেন। পুলিশ দিয়ে হয়রানি, পা ভেঙে দেয়া ও চোখ তুলে নেয়ার হুমকিসহ নানারকম মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সদা শিক্ষকদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখতেন তিনি। কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারির কাছ থেকে মাসিক মাসোয়ারা আদায় করতেন।

উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ: উপবৃত্তির জন্য আবেদনকারী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ফরম পূরণের নাম করে ১৫০ টাকা করে আদায় করতেন। তিনি প্রকৃত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি না দিয়ে নিজ ইচ্ছেমত তা প্রদান করতেন। বোর্ড থেকে প্রদেয় এসএসসির শিক্ষাবৃত্তি নিজে তুলে শিক্ষার্থীকে কম দিয়ে সিংহভাগ আত্মসাৎ করতেন। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণাদি প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ব্যবসা শিক্ষা বিভাগের এক শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা নিজ অ্যাকাউন্টে নেন এবং সে টাকা শিক্ষার্থীকে না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এডমিট কার্ড আটকিয়ে হয়রানি ও টাকা আদায়: একবছর এইচএসসি পরীক্ষার তিনদিন আগে বৃহস্পতিবার তিনি এবং অফিস সহকারী নান্নু মিয়া দুজনে মিলে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বলেন যে,“তাদের এডমিট কার্ড আসেনি। বোর্ড থেকে আনতে হবে। তবে ৩০০০ হাজার করে টাকা দিলে তারা বোর্ড থেকে এনে দিবেন।” এরপর শিক্ষার্থীরা নিরুপায় হয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০০০ টাকা করে আদায় করে শনিবার তাদের এডমিট কার্ড প্রদান করেন। যেহেতু শুক্রবার এবং শনিবার সরকারি ছুটি তাই বোর্ড থেকে এডমিট কার্ড এনে শনিবার শিক্ষার্থীদের দেয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়, এডমিট কার্ড কলেজে আসার পরও শিক্ষার্থীদেরকে তা না দিয়ে হয়রানি করে অর্থ আদায়ের জন্য এটি করা হয়। পরে কলেজের শিক্ষকরা এটি কেন করা হয়েছে তা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং অফিস সহকারী নান্নু মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করে দেন, যার কারণে শিক্ষকরা এ বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলতে সাহস করেননি।

ভর্তি কার্যক্রমে ইচ্ছাকৃত ভুল ও টাকা আদায়: কলেজে ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে শুরু হওয়ার পূর্বে অলিউর রহমান এর সহযোগিতায় অফিস সহকারি নান্নু মিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বোর্ড ভর্তি তথ্যে শিক্ষার্থীদের নাম বা বাবার নামের বানান ভুল করতেন এবং পরে তা সংশোধনের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করতেন।

প্রকাশ্যে ধূমপান: সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অলিউর রহমান ও অফিস সহকারী নান্নু মিয়ার মধ্যে দহরম মহরম সম্পর্ক। তারা দু’জনে অফিসে বসেই প্রকাশ্যে ধূমপান করতেন, এখনও ক্যাম্পাসে বসেই ধূমপান করেন। তাদের দু’জনের এর চেয়েও গুরুতর অপরাধের অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে, যা পরবর্তী প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হবে।

১৪ বছরে ম্যানেজিং কমিটির মিটিং না হওয়া: ১৪ বছর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো ম্যানেজিং কমিটির মিটিং করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ইচ্ছেমত রেজুলেশন লিখে জোর করে এমপি মহোদয়ের প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক প্রতিনিধির সাক্ষর আদায় করতেন। অনেক অভিভাবক-প্রতিনিধিই জানেন না তিনি ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। পরে ঐ স্থানে তিনি নিজেই সাক্ষর করতেন। তবে এমপি মহোদয় এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। শিক্ষকগণ এমপি মহোদয়ের কাছে যেতে চাইলে তিনি হুমকি দেন এই বলে,“আমি এমপির নাত-জামাই, তোমাদের কথা এমপি শুনবেন না। পরে কিন্তু তোমাদের দেখে নিব।”

কলেজের আয় ব্যয়ের হিসাব নেই খাতায়: কলেজের ১৪ বছরের আয় ব্যয়ের হিসেব নেই খাতায়। কলেজের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ বিভিন্ন নথিপত্র তিনি আত্মসাৎ ও গোপন করে ফেলেছেন বলে অভিযোগ বর্তমান অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলামের।

পাশ করিয়ে দেয়ার নামে অর্থ আদায়: উপজেলার রাজাপুর নিবাসী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অকৃতকার্য এক শিক্ষার্থীকে বোর্ড থেকে পাশ করিয়ে দেয়ার নাম করে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করেন অফিস সহকারি নান্নু মিয়া। যে বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অলিউর রহমান অবগত ছিলেন। পরে এ বিষয়ে কয়েকবার শালিসি হলেও টাকা ফেরত পাননি ঐ শিক্ষার্থী।

ক্লাস না নেয়ার অভিযোগ: ক্লাস না নেয়ার অভিযোগ অলিউর রহমানের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের অনেক সাবেক শিক্ষার্থী আমাদের কাছে অভিযোগ করে বলেন,“আমরা কলেজে প্রতিদিন ৬টি বিষয়ের ক্লাস করলেও অলিউর স্যারের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের ক্লাস করেছি বলে মনে পড়ে না। তিনি ২ বছরে ২৪ মাসে আমাদের ২৪ টি ক্লাস নিয়েছেন কিনা তাও সন্দেহ!”

অলিউর রহমানের বক্তব্য: অভিযোগগুলোর বিষয়ে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অলিউর রহমান এর মোবাইল নাম্বার (০১৭৩৪৩৩৯৩৭৮) এ মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে তিনি গণমাধ্যমে কলেজের বিভিন্ন খাত ও শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে পুরোপুরি অস্বীকার করেননি।

কলেজের শিক্ষার মান: কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অলিউর রহমান ও অফিস সহকারি নান্নু মিয়ার নামে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও কলেজের অন্য শিক্ষক ও তাদের পাঠদান বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের। জানা গেছে, শরণখোলার অন্যান্য কলেজ থেকে প্রতিবছর শিক্ষায় এগিয়ে থাকছে এই কলেজটি। প্রতি বছর দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে কলেজটি থেকে শিক্ষার্থীরা। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সিরিয়ালেও প্রথম দিকে থাকছে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে “খ” ইউনিটে সাইফুল ইসলাম ৯৪ তম, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে মোঃ রাকিব “গ” ইউনিটে ২১০ তম হন। এছাড়া কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী মোঃ শোয়েব হাওলাদার প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক লাভ করেছেন।

অভিভাবকদের বক্তব্য: নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন অভিভাবক বলেন,“অলিউর রহমানের মতো দুর্নীতিপরায়ণ একজন শিক্ষকের কারনে কলেজ আজ ধ্বংশের মুখে। আমরা তার সকল অপকর্মের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের দাবি করছি।”

সাবেক শিক্ষার্থীদের বক্তব্য: মাতৃভাষা কলেজ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা বলেন,“আমরা কলেজে অধ্যায়নকালীন অলিউর স্যার এবং নান্নু মিয়ার দুর্নীতির বিষয়ে জানতাম। প্রায়ই দেখতাম নান্নু মিয়ার কাছে মটর সাইকেল নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী আসতো পাওনা টাকা চাইতে। আমরা উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। আমরা চাই না কারও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আমাদের প্রিয় কলেজের ক্ষতি হোক।” তবে এতদিন কেন আপনারা এ বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলেননি জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা বলেন,“আপনারা জানেন তো কথায় আছে পানিতে বসে কুমিরের বিরুদ্ধে যাওয়া যায় না।”