স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদেরই অন্যতম আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। নৌবাহিনীর একজন সাহসী অফিসার, একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিকালে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বৈষম্য লক্ষ করে তিনি ক্ষুব্ধ হন। একপর্যায়ে বাঙালি অফিসার ও সেনাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। এর ফলে তিনি পাকিস্তানি, বিশেষত পাঞ্জাবিদের বিরাগভাজন হন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে ১৯৬৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২ নম্বর আসামি। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে বঙ্গবন্ধু ও তাঁকেসহ সব আসামিকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তখন তিনি লে. কমান্ডার ছিলেন। তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি।

১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে। সরকার ১৯৬৮ সালে ফৌজদারি আইন সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ নামে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ গঠন করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত এ মামলার ৩৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালের শুরু থেকে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৌবাহিনীতে অবস্থানরত বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলা, সেনা ও বিমান বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা, কার্যক্রম সফল করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সহ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সিভিল সার্ভিসের বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গোপন বৈঠক এবং সংগঠন পরিচালনার তহবিল সংগ্রহ করার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। প্রবল গণআন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করলে মোয়াজ্জেম হোসেন মুক্তিলাভ করেন। এরপর তিনি পুনরায় চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ অবসর গ্রহণ করেন।

অবসর গ্রহণের পর মোয়াজ্জেম হোসেন প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালের ২৪ মার্চ তিনি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ২৮ মার্চ লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেন। এ লক্ষ্যে তিনি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন, এক দফা প্রভৃতি পুস্তিকা রচনা করেন। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মোয়াজ্জেম হোসেন লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটিকে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করেন। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে যেকোন ধরনের সমঝোতার পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেন এবং এ উদ্দেশ্যে ১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া সফর করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে কর্নেল তাজের নেতৃত্বে একদ পাকসেনা ঢাকায় তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণে ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাঁটির নামকরণ করা হয় বিএনএস শহীদ মোয়াজ্জেম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ ১৯৯৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেছে শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন সড়ক।

পাকিস্তানি বাহিনী মোয়াজ্জেমকে অভিযানের শুরুতেই তাঁকে হত্যা করে। মোয়াজ্জেম তখন থাকতেন সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছের একটি বাসায়। সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তার স্ত্রী কোহিনূর মোয়াজ্জেম বলেন, ‘তিনতলা বাসা। মোয়াজ্জেম নিচের তলায় থাকতেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। ২৫ মার্চও অনেক নেতা-কর্মী এসেছিলেন। তাঁরা চলে গেলে রাত ১২টার পর থেকে ট্যাংক চলার ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।’

এর পরের ঘটনা বলতে গিয়ে কোহিনূর বেগম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘জিপ গাড়ি ও বুটের আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অনেক আর্মি অস্ত্র তাক করে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়ানো। কমান্ডার মোয়াজ্জেম কোথাও লুকিয়ে ছিলেন। আর আর্মিরা তাঁকে খুঁজছিল। তাঁকে না পেয়ে তারা চেঁচিয়ে বলে, “মিসেস মোয়াজ্জেম কোথায়?” তখন তিনি (মোয়াজ্জেম) বেরিয়ে নিচে গিয়ে বলেন, “আমিই কমান্ডার মোয়াজ্জেম।” ওরা তাঁকে উর্দুতে কয়েকবার বলেছে, “বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ”। তিনি বলেছেন, “না, আমি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলব না। আমার এক দফা, বাংলাদেশ স্বাধীন চাই।” সঙ্গে সঙ্গে ওরা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়েও মোয়াজ্জেম বলেছেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন চাই।” দোতলার জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। এরপর সেনারা তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়নেট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। তখন সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। দেখলাম তাঁকে চ্যাংদোলা করে ওরা নিয়ে যাচ্ছে। তখনো মাথাটা ঝুলছে। এ দৃশ্য দেখে আমি চিৎকার দিয়ে উঠি।’

বেগম মোয়াজ্জেমের বড় আক্ষেপ, তিনি তাঁর স্বামীর লাশটিও ফিরে পাননি। টিক্কা খান নাকি মোয়াজ্জেমকে হত্যা করে তাঁর লাশ নিয়ে যেতে বলেছিল।

আগরতলা অভিযুক্ত মামলায় আসামীরা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন সংগ্রামের ডান হাত এবং আপনজন। তাদের সবাইকে জাতীয় বীর ঘোষণা করতে বর্তমান সরকারকেই। জাতি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ হন তাঁর স্বামী লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের জন্ম ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর জেলার ডুমুরিতলা গ্রামে। তাঁর পিতা মোফাজ্জেল আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। মায়ের নাম লতিফুননেছা বেগম। তার ডাক নাম লাল মিয়া।

শহীদ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।

 

।।এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।

[ মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]