নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে এই মুহূর্তে দুই লাখ আট হাজার দ্বৈত ভোটার রয়েছেন। এদের মধ্যে ৯২৭ জনের অসৎ উদ্দেশ্যে দ্বৈত ভোটার হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তাদের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা আইন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইনের আওতায় মামলা দায়ের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও কার্যক্রম চলছে।

এছাড়া অবশিষ্ট দ্বৈত ভোটারদের দ্বিতীয় পরিচয়পত্র ব্লকড করে দিয়ে প্রথমটি চালু রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে যেগুলো সন্দেহভাজন তাদের দুটো এনআইডিই ব্লকড করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও দ্বৈত ভোটারদের নোটিশ করার পাশাপাশি উদ্দেশ্য যাচাই করা হচ্ছে। এদের মধ্যে কারও অসৎ উদ্দেশ্য পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর অন্যদের প্রথমটি রেখে দ্বিতীয়টি ব্লকড ও কর্তন করা হবে। এক্ষেত্রে না বুঝে বা প্ররোচনায় পড়ে দ্বৈত ভোটার হওয়া কোনও ব্যক্তি যদি নিজের থেকে ইসিতে আবেদন করে ভুল স্বীকার করেন, তাহলে তাদের বিষয়টি সদয় বিবেচনা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, সাধারণত দ্বৈত ভোটার হওয়ার ঘটনা ঘটে কিছুটা অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে। ভোটার হিসেবে নিবন্ধন হওয়ার পর দীর্ঘ সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে না পাওয়া, নিবন্ধনের স্লিপ হারিয়ে ফেলা, প্ররোচনা, শিক্ষা সনদ ও জন্ম নিবন্ধনের বয়সের সঙ্গে ভোটার হিসেবে বয়সের গড়মিল থাকায় সনদ অনুযায়ী দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেন অনেকে। এছাড়া জেনে ও বুঝে উদ্দেশ্যমূল্যকভাবেও কেউ কেউ দ্বৈত ভোটার হয়ে থাকেন। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরনো প্রযুক্তির ডিভাইস, কারিগরি ত্রুটির ফাঁক গলিয়ে, দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততার কারণেই দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার সুযোগ নেয় এক শ্রেণির নাগরিক।

এদিকে দ্বৈত ভোটার হতে সহযোগিতা, রোহিঙ্গাদের ভোটার করাসহ নানা কারণে গত আট বছরে ৩৯ জন কর্মচারীকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ইসির মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে ছবিসহ যখন ভোটার তালিকা তৈরির কাজ হয়, সেই সময় যে ডিভাইসের মাধ্যমে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হতো, তা উন্নত প্রযুক্তির না হওয়া, অতীতের ধারাবাহিকতায় জনপ্রতিনিধি বা সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধিরা একই ব্যক্তিকে একাধিক নির্বাচনি এলাকায় ভোটার করার প্ররোচনা, শিক্ষা সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর না হওয়া বা ভিন্ন নামে মিথ্যা তথ্য নিয়ে ভোটার হয়ে পরে সনদ পাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ভোটার হওয়া, কোনও ব্যক্তি আগে ভোটার হয়েছেন কিনা, তা মাঠ পর্যায়ে যাচাইয়ের ব্যবস্থা না থাকা, নিবন্ধন করার পর স্লিপ হারিয়ে ফেলে এনআইডি তুলতে না পারা, নিবন্ধন করার পর দীর্ঘ সময় হাতে কার্ড না পাওয়ার কারণে অনেকে দ্বিতীয়বার ভোটার হন।

এদিকে ভোটার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো বাধ্যতামূলক করার কারণেও দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার সুযোগ কমে গেছে। এখন জন্ম নিবন্ধন, ইউপি চেয়ারম্যান ও পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দেওয়া নাগরিকত্ব সনদ, শিক্ষা সনদ, পিতা-মাতার এনআইডি, ইউটিলিটি বিলের কপি এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস বই/নিয়োগপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ২০০৮ সালে ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনোটিরই প্রয়োজন পড়েনি। ইসি ধাপে ধাপে ডকুমেন্টগুলোর পরিধি বৃদ্ধি করেছে। অবশ্য এখনও কোনও কোনও সময় ভিআইপিদের সুপারিশের কারণে সব ডকুমেন্টের বদলে দুই/তিনটি ডকুমেন্টের ভিত্তিতেই ভোটার নিবন্ধনের বিষয়টিও দেখা গেছে। সম্প্রতি বহুল আলোচিত ডা. সাবরিনার দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে এমনটি হওয়ার কথা জানান ইসির কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী বলেন, ‘অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে দ্বৈত ভোটার হন। আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে না জেনে-বুঝে বা একাধিক এলাকায় ভোটার হওয়ার প্রত্যাশায় হয়ে থাকেন। জনগণকে সচেতন করতে পারলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে এটা থাকবে বলে মনে হয় না।’

বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে মাঠ প্রশাসনের ভোটার যাচাইয়ের সুযোগ সম্পর্কে মাঠ প্রশাসনে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা জানান, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের থেকে এই ধরনের সুযোগ দেওয়ার একটা দাবি এসেছে। তবে, স্পর্শকাতর এই বিষয়ের অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দুই লাখ সাত হাজার দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত করেছি। এগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। এসএমএস বা অন্য সম্ভাব্য পদ্ধতিতে নোটিফাই করা হয়েছে। দেখছি উদ্দেশ্য কী ছিল? যারা উদ্দেশ্যমূলক করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ উদ্দেশ্য অসৎ না হলে মানবিক বিবেচনায় প্রথমটি রেখে দ্বিতীয়টি স্থায়ীভাবে ব্লকড করে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ও দ্বৈত ভোটার ঠেকানোসহ জালিয়াতি বন্ধে তারা প্রযুক্তি উন্নতি করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছেন উল্লেখ করে এনআইডির ডিজি বলেন, ‘আমরা এনআইডির সার্ভার শক্তিশালী ও এর নিরাপত্তা বাড়িয়েছি। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরো কাজ মনিটরিং করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনও আইডি থেকে কতক্ষণ কী কাজ করা হচ্ছে—তা সংক্ষণের ব্যবস্থা থাকছে। এছাড়া কমিটি গঠন করে মাঠ প্রশাসনে ঝটিকা অভিযান শুরু করেছি।’