আমার আদরের ছোট ভাই পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে জুস খাওয়ানোর সময় টয়লেটে নেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ঘাতকরা। তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার তরতাজা ভাইকে নিথর লাশে পরিনত করেছে। এমনিভাবে এএসপি আনিসুল করিম শিপন হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছিলেন নিহতের বোন ডা, উম্মে সালমা। তিনি রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের গাইনী বিভাগের চিকিৎসক।

তিনি বলেন, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আনিসুল করিম শিপন সবার ছোট। সে ছিল পরিবারের সবার আদরের। আমরা কখনো তাকে ফুলের একটি আঁচরও লাগতে দেই নি। শিপন ছিলেন মেধাবী ও সদালাপী এবং বন্ধুবৎসল। তিনি গাজীপুর জেলা শহরের রাণী বিলাশ মনি সরকারী উচ্চ বালক বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি পাশ করেন। ২০০২ সালে কাজী আজিম উদ্দীন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩তম ব্যাচে লেখাপড়া করে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ৩১তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশের চাকুরীতে যোগদান করেন। পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপন বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) সহকারি পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন।

ডা. সালমা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শিপন কিছুটা অসুস্থ্যতা বোধ করছিল। তাকে চিকিৎসার জন্য গত সোমবার সাড়ের ১১টার দিকে আমি ও আমার বড় ভাই রেজাউল করিম সবুজ রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে শিপনকে নিয়ে যাই। সেখানে ভর্তির ব্যাপারে আমরা নীচতলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি শিপনকে জুস খাওয়াচ্ছিলাম। এসময় শিপন টয়লেটে যেতে চায়। হাসপাতালের কয়েক কর্মচারি টয়লেটে নেওয়ার কথা বলে ভাই শিপনকে আমার হাত দোতলায় নিয়ে যায়। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যেই এক কর্মচারি এসে আমাকে দোতলায় যেতে বলে। আমি দৌড়ে দোতলায় গিয়ে একটি কক্ষের দরজা বন্ধ দেখতে পাই। আমি ওই কক্ষে প্রবেশ করে মেঝেতে উপুড় হয়ে ভাইয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি। সেখানে কেউ ছিল না। সবাই ভাইকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকতে থাকি এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার ও সাকার মেশিন নিয়ে আসতে বলি। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। অগত্যা আমি নিজেই ভাইরে বুকে চাপ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস সচল করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এসময় তার নাক মুখ দিয়ে পেট থেকে খাবার বের হয়ে আসতে থাকে। এ মর্মান্তিক দৃশ্য না দেখলেই নয়।

তিনি আরো বলেন, আমরা হাসপাতালে পুলিশ কর্মকর্তা ভাইয়ের পরিচয় দিয়েছি। আমরা বলেছি ওর তেমন কোন সমস্যা নেই। ওর একটু কমফোর্ট দরকার। অথচ কে জানতো যে হাসপাতালে নেওয়ার পর ভর্তির আগেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমার ভাই সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠবে। এটা আমরা কোন দিন ভাবি নাই। যাকে আমরা কখনো একটি ফুলের টোকা পর্যন্ত দেইনি, সেই ভাইকে ওরা আমার হাত থেকে নিয়ে নির্যাতন করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

নিহতের বোন ডা. উম্মে সালমার কথা শুনে গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এসময় উপস্থিত সবার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। পুলিশ সুপার তাদেরকে শান্তনা দেন।

এসময় নিহতের স্ত্রী শারমিন সুলতানা আহাজারী করে বলেন, আমার স্বামীকে সুস্থ্য করার জন্য আমি হাসপাতালে পাঠিয়েছি। অথচ সেখানে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমন কেন হলো ? এখন আমার ও আমার একমাত্র সন্তানের কি হবে ? আমার সন্তানকে এখন কে বাবা বলে আদর করে জড়িয়ে কোলে তুলে নিবে। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই। এসময়ে মায়ের (শারমিন সুলতানা) পাশে থাকা চার বছরের শিশু সাফরান তার বাবা শিপনকে খুঁজছিলেন। গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারসহ উপস্থিত স্বজনরা এসময় তাদের শান্তনা দেন।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাগণ বুধবার পুলিশের নিহত সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে গাজীপুর শহরের বরুদা এলাকার বাসায় গেলে এ দৃশ্যের অবতারনা হয়।

প্রসঙ্গতঃ পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপন বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) সহকারি পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। গত সোমবার তাকে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে হাসপাতালের কর্মচারীদের নির্যাতনে তিনি নিহত হন। তার বাসা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বরুদা এলাকায়। তবে তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সম্মানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামে। তার স্ত্রী ও সাফরান নামের চার বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।