স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকার রাজপথ। সাতই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও অগ্নিগর্ভ। ২৫ মার্চ কালরাতে এদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম নৃশংসতম গণহত্যা। মূক্তিযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণহত্যার পরে জিয়াউর রহমান তার পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দি করে বিদ্রোহ করেন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সমর্থনে একটি বিবৃতি পাঠ করেন (জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় টেলিভিশন চ্যানেল আই ‘তৃতীয় মাত্রায়’ সাবেক ডাকসু ভিপি ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বলেছেন, অপ্রিয় হলেও সত্য, ২৭শে মার্চ আমি নিজে শুনেছি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন’ এটা আমাকে স্বীকার করতে হবে।)। স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য দরকার ছিল একটি গণতান্ত্রিক এবং জনবান্ধব সরকার গঠন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এর আগে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

মুজিবনগর সরকার তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিলো বলে এ সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামেও পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিলো মুজিবনগর সরকারের কার্যকাল। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দফতর স্থাপন করেছিলো, তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো মুজিবনগর সরকার রূপে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয়। প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন, সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং যুদ্ধে সাহায্যকারী রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষা ছাড়াও মুক্তিকামী জনতাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য এ সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মূলত ‘মুজিবনগর সরকার’-এর অধীনেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এ কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মুজিবনগর দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। সদ্য শপথ নেওয়া নবগঠিত এই মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রে দেশের সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। শপথ গ্রহণের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সরকার। মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হলেও কার্যত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মূল চালিকা শক্তি। যুদ্ধকালীন সময়ে সরকারের বিভিন্নমুখী তৎপরতা যুদ্ধকে গতিময় রাখতে সহায়তা করে।

মুজিবনগর সরকার কাঠামো এবং মন্ত্রণালয়সমূহের ভূমিকা ও কার্যবিবরনী সংক্ষেপে তুলে ধরা হল :
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- রাষ্ট্রপতি।
২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি ।
৩. তাজউদ্দীন আহমদ- প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব বিষয় কারও ওপর ন্যস্ত হয়নি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।
৪. খন্দকার মোশতাক আহমদ- মন্ত্রী, পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
৫. এম মনসুর আলী- মন্ত্রী, অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
৬. এ এইচ এম কামরুজ্জামান- মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়।
ছাড়াও কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত।
•পরিকল্পনা কমিশন
•শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড
•নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
•ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
•শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড ।
•প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এস.এ সামাদ প্রতিরক্ষা সচিব।
• মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানী, চীফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি এ.কে খন্দকার, এবং ডি.জি মেডিকেল সার্ভিস ও বিভিন্ন পদবীর স্টাফ অফিসার এ দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। তবে ১০নং বা নৌ সেক্টরে কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না, কমান্ডোরা যখন যে এলাকায় অভিযান করত সে সেক্টরের কমান্ডারের অধীনে থাকত। এ ছাড়াও জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডগুলির কমান্ডার হলেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর কে.এম সফিউল্লাহ।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে বহির্বিশ্বের সরকার ও জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে এ মন্ত্রণালয়।‌

মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় সভায় বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন, সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ এবং এসব বিষয়াদি লিপিবদ্ধকরণ মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের আওতাভুক্ত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবার পর পরিষদের প্রথম দুই মাসের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকাংশই তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করেন। এরপর এইচ টি ইমাম সচিব হিসেবে যোগ দেবার পর অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের সমন্বয়ে সচিবালয় গড়ে ওঠে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় সাধনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সাধারণ প্রশাসন বিভাগের আওতায় জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের পক্ষে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি জেলায় সরাসরি কাজ করা অসম্ভব বিধায় কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে একটি করে প্রশাসনিক জোন গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৯টি জোন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’টি জোন প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি জোনের একটি হেডকোয়ার্টার ছিল এবং একজন চেয়ারম্যান (এমএনএ বা এমপিএ) ও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জোনের দায়িত্ব পালন করেন। সংশ্লিষ্ট জোনের চেয়ারম্যান, সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীদের সমন্বয়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠিত হয়।

দায়িত্ব ও কর্তব্য মন্ত্রিসভা কর্তৃক জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, জোনের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তথা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, উদ্বাস্তুদের ত্রাণ সহায়তা প্রদান, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ত্রাণ প্রদানের বিষয়টির সমন্বয় সাধন, যুব ক্যাম্প গুলোকে সাধ্যমত সহায়তা প্রদান এবং সেক্টর কমান্ডারকে সহায়তা করা জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের প্রধান কাজ ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন যে কার্যকর রয়েছে তা জনগণকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জোনাল প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে ৫ দিনের নোটিশে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা সচিবকে মাসে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হত।

স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ মন্ত্রণালয় একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রথম কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মহাপরিচালককে সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ দুভাগে বিভক্ত ছিল: (ক) সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও (খ) বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ বা সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে নি এমন জনগণকে চিকিৎসা প্রদান। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল, চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ, ঔষধ-পথ্য সংগ্রহ, মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসক দল প্রেরণ, শল্য চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, এবং আহত ও নিহতদের জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা করা। ডা. টি হোসেন প্রথমে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক এবং পরে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বসবাসরত বাঙালিদের মনোবল উজ্জীবিত রাখার প্রয়োজনে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এ মন্ত্রণালয় প্রধানত চারটি মাধ্যমে এর কর্মকান্ড পরিচালনা করত:
(ক) বেতার (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র),
(খ) চলচ্চিত্র,
(গ) প্রকাশনা,
(ঘ) চারুকলা ও ডিজাইন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুক্তাঞ্চল, শরণার্থী ক্যাম্প ও ট্রেনিং ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা এবং যুদ্ধ এলাকা ও মুক্তাঞ্চলে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনার জন্য গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করা হয়।

ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শরণার্থীদের আবেদন বিবেচনা করে তাদের সাধ্যমত সহায়তা প্রদান করা হত। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়: (ক) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি এবং (খ) উদ্বাস্তু কল্যাণ বোর্ড।

সংসদ বিষয়ক বিভাগ পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ বিভাগ কাজ করে। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা এ বিভাগের প্রধান দায়িত্ব ছিল। মুক্তিযোদ্ধা বাছাই, শরণার্থীদের আবাসন ও যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে পরিষদ সদস্যগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এসব কর্মকান্ডের জন্য তাদের ভাতা প্রদান করা হত।

কৃষি বিভাগ যুদ্ধপরবর্তী সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতির বিবেচনায় কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কিভাবে খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবার জন্য এ বিভাগ কাজ করে। নুরুদ্দিন আহমদ কৃষি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

প্রকৌশল বিভাগ যুদ্ধে সেক্টরগুলোতে প্রকৌশল বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ করে দ্রুত রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত এবং সেতু মেরামতের জন্য কিছুসংখ্যক প্রকৌশলীকে এ বিভাগের অধীনে নিয়োগ করা হয়। এমদাদ আলী প্রধান প্রকৌশলী নিযুক্ত হন।
যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ড মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী যুবকদের প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে এবং পরে সেখান থেকে যুবক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হত। জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলগুলোর আওতায় উভয় ক্যাম্প পরিচালিত হত। এ বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে মোট ১০৬টি যুব ক্যাম্প ও ১১২টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প ছিল। বোর্ডের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের বাজেটেই উভয় ক্যাম্প পরিচালিত হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া প্রতিটি ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন একজন করে এমএনএ বা এমপিএ।

উল্লেখ্য, যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দফতর স্থাপন করেছিলো। তাই এর ব্যাপক পরিচিতি মুজিবনগর সরকার রূপে। প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবিধার্থে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করে।

বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত ইন্দিরানি (জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর এলাহাবাদ, ভারত)। পুরো নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহরু। কংগ্রেস নেতা ফিরোজ গান্ধীর সাথে বিয়ের পর ইন্দিরা নামের সঙ্গে গান্ধী কথাটা ব্যবহার করেন। যদিও তাদের বৈবাহিক জীবন খুব অল্প সময়ে ইতি টানে। কিন্তু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নামটি এর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উঠতি বয়সেই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অত্যন্ত জেদি প্রকৃতির অনেক প্রপিতামহির স্বভাব পেয়েছিলেন। যেটা করতে চাইতেন‌ প্রাণপণে সেটাই করতেন। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি পরে নানাভাবে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ একটা রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছিল এবং ইন্দিরা শক্ত হতে তা সামাল দিয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ইন্দিরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁকে দুটো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমটি হলো কংগ্রেসের বৈরী জ্যেষ্ঠ নেতাদের বৃন্তচ্যুত করে দলে ও পার্লামেন্টে নিজের অবস্থান মজবুত করা। ১৯৬৯ সালের মধ্যেই তিনি এ কাজে পুরোপুরি সফল হন। এরপরের চ্যালেঞ্জটি ছিল ‘বাংলাদেশ’। একাত্তর সালের টালমাটাল সময়টা তিনি উতরে গেলেন প্রচণ্ড সাহস, ধৈর্য আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

এখন যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ, তা একসময় ভারতের পেটের মধ্যে ছিল। পরে তা ঢুকে যায় পাকিস্তানে। ভূরাজনৈতিক কারণেই ১৯৭১ সালে ভারত জড়িয়ে পড়ে, যা কিনা ছিল পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ’ রাজনৈতিক সংকট। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্বনির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে বাঙালিরা এটাকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ছল হিসেবেই বিবেচনা করেছিল। ভারত তখনই নড়েচড়ে বসে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২ মার্চ তাঁর দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এ দুজন হলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পরমেশ্বর নারায়ণ হাকসার এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব রামেশ্বরনাথ কাও। কাও একই সঙ্গে ছিলেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান। ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের ‘বাংলাদেশকে সাহায্য’ করার ব্যাপারে মূল্যায়ন করতে এবং ‘স্বাধীন বাংলাদেশকে’ স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন (সূত্র: হাকসার পেপারস, ২ মার্চ ১৯৭১)।

১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কিন্তু কৌশলগত কারণে ভারত ছিল তখন সাবধানী।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে বসেই পরিচালিত হতো। এতে ভারত সরকারের সর্বাত্মক সহায়তা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই বলে থাকেন ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না থাকলে ইতিহাস মুর পাল্টে যেত! ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে এটি অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের দেশে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে সেনা সহায়তা দেওয়াসহ সব ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তা দিয়েছিল ভারত। ভারতের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে স্পষ্টভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। আর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পরই বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মূলত ভারত রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও মতাদর্শগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে। ভুটানের পর দ্বিতীয় বিদেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে পূর্ণ বিজয় অর্জনের ১০ দিন আগেই ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওই দিন একটি চিঠি দিয়েছিলেন মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানান এবং ভারতের পার্লামেন্টে ওই দিন সকালে এ বিষয়ে তার বিবৃতির কথাও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখা ইন্দিরা গান্ধীর সেই চিঠি স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিনগুলোয় মুজিবনগর সরকারকে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেরণা জুগিয়েছিল। এর বাইরেও ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দান বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ছিল। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ দিক পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক ব্যক্তিকে আশ্রয়দানের সুযোগ দেয়। কলকাতায় একটি প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য স্বল্প পরিমাণে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারত কূটনৈতিক প্রচারণা অব্যাহত রাখে।

মে মাসের শুরু থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এ সময়ে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। যার কারণে ভারতীয় সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি আন্দোলন নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ সময় ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন দিতে থাকে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ সময়ে ভারত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা জোরদার করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন করা হয়। ভারত কর্তৃক প্রেরিত তিনটি সৈন্য বহরের দুটি ছিল সপ্তম পদাতিক, একটি ছিল নবম পদাতিক যাদের ভারত পূর্ব বাংলার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে। এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সমর্থন দানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কার্যকর কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন পায়। ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সহায়ক অংশগ্রহণের ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
অনেক ইতিহাস গবেষক ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিযুদ্ধের ধাত্রী বলে অভিহিত করেছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার সমর্থন ভারতের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশটি ছিল একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটান। ভুটান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সরকার ছাড়াও তৎকালীন ভুটানের জনগণও বাংলাদেশের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানায়। ১৯৭১ সালে একজন সমাজকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ছোট রাষ্ট্র নেপালও এই সময় চুপচাপ ছিল না। তাদের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রথমত ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ গুর্খা রেজিমেন্ট। গুর্খারা মূলত নেপালি। এরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে আমাদের যুদ্ধে অংশ নেয়।

ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, টাইমস, ইকোনমিস্ট, সানডে টাইমস, অবজারভার, বিবিসিসহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যম মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন ও বাঙালিদের দুর্দশা বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধুর ভূমিকা পালন করে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী ও সমব্যথী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন রাসেল জন স্টোনহাউস। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। হাউস অব কমন্স সভায় তিনি বলেন, আমার মনে হয় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করবেই। স্বাধীনতা লাভ করতে তাদের অনেক মাস লাগতে পারে অথবা কয়েক বছর লাগতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা অসম্ভব মনে হয় যে এক হাজার মাইল দূরের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের একটি দেশে পাকিস্তান শাসন ধরে রাখতে পারবে। বিশেষ করে সেখানকার মানুষ যখন তা চাইছে না। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও স্টোনহাউস বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে দুর্গত বাঙালিদের ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত শরণার্থীদের জন্য ব্রিটিশ সরকারের সহায়তার পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। এ ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও ব্রিটিশ সরকার দুই মিলিয়ন পাউন্ড অর্থের ত্রাণ সহযোগিতা পাঠিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ছাড়াও বেসরকারিভাবে ব্রিটিশ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল।

বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন ছিল। এটি সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন জাপানের ডায়েটের প্রভাবশালী সদস্য হায়াকাওয়া। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে জাপান তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। স্বীকৃতিদানের এক মাসের মধ্যে ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৩-১৪ মার্চ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধি দল প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে। দেশে ফিরে ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সাতোর কাছে প্রতিনিধি দল দুটি প্রস্তাব পেশ করে বাংলাদেশকে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান অবিলম্বে প্রদান এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা। এই সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ২৮ মার্চ ১৯৭২ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। ওই বছর ৬ জুন জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এবং পরবর্তীতে জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলে হায়াকাওয়া তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে আমৃত্যু এর নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।

মুসলিম এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিসর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। এর বাইরে ইরাকও বাংলাদেশকে সমর্থন করে।বাংলাদেশের পক্ষে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের শরিক ভারতের অবস্থানকেই সমর্থন করেছে তারা। সেই সূত্রেই গণহত্যার বিপরীতে অবস্থান ছিল মিসরের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথমদিকের রাষ্ট্রগুলোর একটি মিসর। মিসরের মিডিয়ায়ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে লিখেছেন অনেকে।

বিশ্বের আরও বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যেমন- কিউবা, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, ইরাক , চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি প্রভৃতি তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং যুদ্ধকে সমর্থন করে। নানা রকম কর্মসূচি পালন করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।

লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্বজনমত সৃষ্টি ও দান সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ৪০ হাজার লোকের সমাগমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডভিত্তিক গান পরিবেশন করেন।

অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডার প্রচার মাধ্যমগুলো পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করে। তাদের যৌথ ভূমিকা আমাদের যুদ্ধজয়ে অনুপ্রেরণা ও শক্তির অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দেশসমূহ: স্বাধীনতাকে চৌ এন লাই “এক অন্তহীন যুদ্ধের সুচনামাত্র” বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের জুন মাস থেকে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন প্রতিদিন ১০০টি লরি ভর্তি সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়।শুধু ৭১ সালে চীন পাকিস্তানকে প্রদান করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক উপকরণ। যার বেশীরভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙালি নিধনে।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চীনের বৈরীতা বন্ধ হয়নি। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকাস্থ চীনা কন্স্যাল অফিস তারা বন্ধ করে দেয়। ৭২ সালের ২১ শে আগস্ট চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যভুক্তির প্রশ্নে প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা বরাববরই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে আসছিল সঙ্গে ছিল চীন। এই দুই বৃহৎশক্তি পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতা করে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা তার প্রভাব খাটায়। কোনো দেশ যাতে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা ও সমর্থন না করে।

ডিসেম্বর মাসের পহেলা দিকে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। আমেরিকা, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক বাদানুবাদও শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করেছিলেন। আমেরিকার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে ভারতকে থামানো এবং পাকিস্তানকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করা।ভারতের ওপর এক ধরণের সামরিক হুমকি তৈরি করতে বঙ্গোপসাগরে রণতরীও পাঠিয়েছিল আমেরিকা।

আরব বিশ্বের চোখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল, ইসলামী ঐক্য-বিরােধী অপ্রয়াস বা ইসলামী সংহতির প্রতি হুমকি। এজন্য ৭১ সালে ওআইসির জেদ্দা সম্মেলনে ২২টি দেশ অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌছায়। জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত অবস্থানকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। উক্ত অধিবেশন শেষে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সমর্থন জানানাের পাশাপাশি, যেসব বিদেশি শক্তি পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনাশের ষড়যন্ত্র করছে তাদের কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানানো হয়।

পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা থেকে বিরত রাখার জন্য মার্কিন কংগ্রেস যখন নিক্সন প্রশাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে। তখন সৌদি আরব, লিবিয়া, ইরানসহ বেশ ক’টি মুসলিম দেশ জঙ্গিবিমান, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল। শুধু তাই নয় ইরান ওই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা ঘােষণা প্রদান করে।

এছাড়াও শ্রীলংকা তাদের বিমানবন্দর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র, যুদ্ধবিমানের জ্বালানি শ্রীলংকান বিমান বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমেই এদেশে আসতো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নানামুখী চাপ ও ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও এ সরকার কাজ করে গেছে বিরামহীনভাবে। যার চাক্ষুষ প্রমাণ দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি রক্তপিপাসু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইয়ের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। তবে বিশ্বের অন্য কোন দেশ এতো কম সময় স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে নাই। মুজিবনগর সরকার শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাই নয় বরং বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনসমর্থন আদায়ে জোর তৎপরতা চালায়। মুজিবনগর সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান করে নেয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাথে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাই এদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা মুজিবনগর সরকারের নাম।

লেখক: মোঃ রেজোয়ান ইসলাম।