কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন মহিয়সী রমনী। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত লেখক ও কবি। তার লেখা বিখ্যাত কবিতা “ আদর্শ ছেলে” পডেনি, এমন শিক্ষিত বাঙালি হয়তো এই ধরনীতে খুঁজে পাওয়াবিরল। এই মহান বাঙালি নারীর সন্তান বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি। মা কবি বলে হয়তো সাহিত্য দেবতা সন্তানের মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার সঞ্চার ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের বরিশালে ১৮৯৯ সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারি ,কুসুমকুমারী দাশের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিরিশের দশকের তথাকথিত জনবিচ্ছিন্ন কবি, এখন যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক কবি জীবনানন্দ দাশ।

বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রবাদ পুরুষ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী একজন কবি। সেসময়েপ্রায়সমস্ত কবি সাহিত্যিক কবিগুরু দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে জগতের সমস্ত উজ্জ্বল গ্রহ-নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হতেন। তবে জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কক্ষপথ ছিল রবি বলয়ের বাইরে। বাংলা সাহিত্যের তিরিশের দশকের জনপ্রিয় পাঁচজন সাহিত্যিকদের, যারা পঞ্চপান্ডব নামে সমধিক পরিচিত এবং রবীন্দ্র সাহিত্য প্রভাবমুক্ত, মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়েছিলেন। কবিগুরু জীবনানন্দের কবিতা পড়ে চিঠিতে লিখেছিলেন, “ তোমার কবিতাগুলো পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে”। জীবনানন্দ দাশকে কবিগুরু ভালোভাবেই আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে “চিত্ররূপময় কবিতা” বলে অভিহিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মাঝে বাংলাদেশের সৌন্দর্য ছবির মত ফুটে উঠেছে। বাংলার রূপ লাবণ্য অবলোকনের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ এক দক্ষ দার্শনিক। তাঁর কবিতার পরতে পরতে গ্রাম বাংলার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য শৈল্পিক পরশে আরো জীবন্ত ও মহীয়ান হয়ে উঠেছে। কবি ছিলেন সৌন্দর্য পূজারী। প্রকৃতির মাঝে তার আরাধনা। কবি বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশকে ‘প্রকৃতির কবি’ বলে অভিহিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশের মতো করে কোন বাঙালি কবি প্রকৃতির অপার মহিমাকে উপলব্ধি করতে পারেননি।

কবির ‘ বোধ’ কবিতায় কবি বলেছেন, “ হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?/ বালতিতে টানিনি কি জল?/ কাস্তে হাতে কতোবার যাই নি কি মাঠে?/ মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে/ ঘুরিয়াছি “। এই কবিতার পঙ্ক্তিগুলো পাঠ করলে যেকোনো পাঠকদের চোখের সামনে একটা রঙিন ছবি ভেসে উঠবে স্বমহিমায়। এক জীবন্ত দৃশ্যপট পাঠক হৃদকে গভীরভাবে রেখাপাত করবে। হয়তো এই কারণেই কবি রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে চিত্ররূপময় কবিতা বলেছেন। প্রকৃতি প্রেমী এই দার্শনিক কবি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মিলে মিশে করেছেন একাকার। হয়ে উঠেছেন বাংলার শুদ্ধতম প্রকৃতি কবি, বাংলার ওয়ার্ডসওয়ার্থ।

কবিতার উপমা বর্ণনায় জীবনানন্দ দাশ হলেন বাংলা সাহিত্যের কবি কালিদাস রায়। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘ উপমা কলিদাসস্য’ যেমন সত্য, তেমনি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘ উপমা জীবনানন্দ দাশস্য’ চিরসত্য। বাংলা সাহিত্যে উপমা বর্ননায় কবি জীবনানন্দ দাশ যেন উপমার জাদুঘর। উদাহরণ হিসেবে তার কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে,যেমন, ‘ নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজ¯্র তারা’ , ‘ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’ । এরকম চিত্ররূপময় উপমা সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ অপ্রতিন্দ্বন্দী। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর উপমা উজ্জ্বল, জটিল ও দূরগন্ধবহ’।

১৯৩৬ সালে প্রকাশিত কবি জীবনানন্দ দাশের “ ধূসর পান্ডুলিপি” অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম বিখ্যাত কবিতা’ মৃত্যুর আগে’ র সাথে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘দা ফলিং অব দা লীভস’ কবিতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যু চেতনা কবির ভাবনার জগতে কতটা প্রবল তা এই কবিতা পাঠের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। ঝরা পাতা, শিরশিরে শিতল হাওয়া, ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয় সভ্যতা, কবি জীবনানন্দ দাশের সহজাত কাব্য বৈশিষ্ট্য এবং বন্ধ্যাযুগের চিত্রকল্প অঙ্কনের ক্ষেত্রে কবির তুলন কবি নিজেই। কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনের এক পর্যাযয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এসময় তার কবিতার রঙিন চালচিত্রের পরিবর্তে হতাশা আর বিবর্ণতা ঠাই করে নেয়।যেমন কবি তাঁর ‘বিভিন্ন কোরাস’ কবিতায় বলেছেন, ‘ পৃথিবীতে ঢেরদিন বেঁচে থেকে আমাদের আয়ু/ এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান।/হদয়কে চোখঠার দিয়ে ঘুমে রেখে/ হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান’। ধূরর রঙের আভা পড়ে তার কবিতার বিষয়বস্তুতে। একারণেই হয়তো অনেক সাহিত্য সমালোচক তাকে ‘ ধূসরতার কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

কবির রোমান্টিক প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির ‘ বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবিতা এবং কবি রচিত সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবিতাটিতে ইংরেজ কবি ও নাট্যকার এডগার অ্যালান পো’র ‘ টু হেলেন’ কবিতার স্পষ্ট প্রভাব থাকলেও ভাব ও সৃজনশীলতার মাপকাঠিতে ‘বনলতা সেন’ এক অনবদ্য সৃষ্টি এবং কবির রোমান্টিক প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এই কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে উপমার প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যেমন, পাখির নিড়ের মতো চোখ, শিশিরের মতো সন্ধ্যা, অন্ধকারের মতো কালো চুল, প্রভৃতি উপমার প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশকে উপমার সম্রাটে পরিণত করেছে। সৌন্দর্য পূজারী কবি জীবনানন্দ দাশের ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ‘ রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, নদীনালা, খালবিল, পশুপাখিসহ বাংলার চিরায়ত উৎসব, অনুষ্ঠানের প্রতিরূপ ফুটে উঠেছে অসাধারণ কাব্যিক ভঙ্গিমায়। জনপ্রিয়তার বিচারে কবি জীবনানন্দের ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের পরপরই রূপসী বাংলার স্থান। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় কবির অভিব্যক্তি এরকম, “ আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়/ হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,..”। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী কবি পরের জন্মেও বাংলায় জন্মগ্রহণ করতে চান। এই কবিতায় কবি যেমন বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি নিজ মাতৃভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা অকপটে ব্যক্ত করেছেন।
কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কর্ম নিয়ে দেশে বিদেশে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যিকের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। বিখ্যাত মার্কিন গবেষক ক্লিনটন বি সিলি কবি জীবনানন্দ দাশের উপর গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তিনি কবি জীবনানন্দ সম্পর্কে বলেছেন, অ ঢ়ড়বঃ ধঢ়ধৎঃ ( নির্জনতার কবি)।

ক্ষণজন্মা এই মহান কবি ১৯৫৪ সাথে সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রামের ধাক্কায় আহত হন। আটদিন পর,২২ অক্টোবর নিদারুণ যন্ত্রনা ভোগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বাংলা সাহিত্যের তিমির হননের কবি জীবনানন্দ দাশ। কবির মৃত্যুর খবর শুনে আহত হদয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন,

“ একটি জাহাজ ছেড়ে গেল
হলো নিরুদ্বেল ও
মনের জেটির কাঠ নেই আর ওঠা-নামা মাল।
যাত্রীর যন্ত্রনা গোলমাল গেছে সমস্ত সকাল ।“ৃ..

আকতারুল ইসলাম
লেখক ও গবেষক