র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব-৪) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে শাহিন উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মানিক। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুরের ইষ্টার্ন হাউজিং এলাকায় র‍্যাব-৪ এর একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয় মানিক।

আজ শুক্রবার সকালে র‌্যাব-৪’র অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পল্লবীতে সন্তানের সামনে বাবাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় করা মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ নম্বর আসামি মো. মানিক র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক আরও জানান, গতকাল রাতে তাদের একটি টহল টিম কাজ করছিল। তারা খবর পান, একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। টহল টিম সেখানে গেলে র‍্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে তারা। আত্মরক্ষার্থে র‍্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। কিছুক্ষণ পর সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলে সেখানে একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের নাম মানিক। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

পল্লবীতে শাহীন উদ্দিনকে যে দুজন কুপিয়ে হত্যা করেছিলেন, তাদের একজন হলেন মানিক। এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) লায়ন এমএ আউয়াল। কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক কিলার সুমন বেপারি। হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পর ৩০ সেকেন্ডের ফোনকলে হাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের এমডি আউয়ালকে কিলার সুমন জানায়, ‘স্যার ফিনিশড’। এ হত্যায় চুক্তি করা হয় ৩০ লাখ টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে ভৈরবের একটি মাজার থেকে শাহিন উদ্দিনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এমএ আউয়ালকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৪। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে চাঁদপুর থেকে হাসান (১৯) এবং পটুয়াখালী থেকে জহিরুল ইসলাম বাবুকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার আল মঈন।

এদিকে গত বুধবার রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সুমন বেপারি (৩৩) ও পল্লবী থানার কালাপানি এলাকা থেকে রকি তালুকদারকে (২৫) গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মিরপুর জোনাল টিম। এর আগে পল্লবী থেকে গত রোববার বিকেলে ডিবির একই টিম হত্যায় অভিযুক্ত মো. মুরাদকে এবং মঙ্গলবার সকালে মো. দিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. আহসান খান সবার গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত সুমন বেপারি, রকি তালুকদার ও মুরাদকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালতে হাজির করা হয় সুমন ও রকিকে। একই সঙ্গে দুই দিনের রিমান্ড শেষে মুরাদকেও আদালতে নেওয়া হয়। এর পর সুমন ও রকিকে ১০ দিন এবং মুরাদকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সুমন ও রকির পাঁচ দিন এবং মুরাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার আল মঈন জানান, গত রবিবার বিকালে কিলার সুমনের নেতৃত্বে চলা সন্ত্রাসী গ্রুপের কিলিং মিশনে নৃশংসভাবে খুন হন সাহিনুদ্দিন। জমি সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়ে মীমাংসার কথা বলে রাজধানীর পল্লবীর ১২ নম্বর ডি ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কে ডেকে নিয়ে ৬ বছরের ছেলের সামনেই চাপাতি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। কিলার টিটুর মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে চুক্তির টাকা যায় সুমনের কাছে।

ঘটনার সময় প্রথমে কিলার সুমন, মনির, মানিক, হাসান, ইকবাল ও মুরাদসহ ১০-১২ জন ধারালো অস্ত্র দিয়ে শাহীনকে এলোপাতাড়ি কোপায়। এ সময় বাবুসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ‘লুকআউট ম্যান’ হিসেবে নজরদারি করে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে সাবেক এমপি আউয়ালের মোবাইলে ফোন করে পল্লবীর চিহ্নিত সন্ত্রাসী সুমন বলে, ‘স্যার ফিনিশড’। এর পর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গাঢাকা দেয়।

প্রকাশ্যে লোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভিকটিমের মা আকলিমা বেগম ২০ জনের নাম উল্লেখ করে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সাবেক এমপি ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়ালকে। অন্য আসামিরা হলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুমন, মো. আবু তাহের, মুরাদ, মানিক, মনির, শফিক, টিটু, কামরুল, কিবরিয়া, দিপু, আব্দুর রাজ্জাক, মরন আলী, লিটন, আবুল, বাইট্যা বাবু, বড় শফিক, কালু ওরফে কালা বাবু, নাটা সুমন ও ইয়াবা বাবু। সব আসামিই পল্লবী থানা এলাকার বাসিন্দা।

কমান্ডার আল মঈন আরও জানান, গ্রেপ্তার আউয়াল একজন আবাসন ও জমি ব্যবসায়ী। আলীনগর বুড়িরটেকে আউয়াল একটি আবাসন প্রজেক্ট করেছেন। সেখানে সাহিনুদ্দিনের পরিবারের জমি রয়েছে। সেই জমি দখল করে নিতে চেয়েছিলেন আউয়াল। এ জন্যই মূলত তাদের দ্বন্দ্ব। আউয়ালের ছত্রছায়ায় সুমন সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে জমিদখল ও আধিপত্য বিস্তার করতেন। আউয়ালের কাছ থেকে তারা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মাসোয়ারা পেতেন। এই সন্ত্রাসী দল এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রিকশার টোকেন বাণিজ্য, মাদক, জুয়াসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়। নিহত সাহিনুদ্দিন ও সুমন গ্রুপের মধ্যে জমির বিরোধে গত দুই মাসে একাধিকবার মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় পল্লবী থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে।

এমএ আউয়াল নিজের আবাসন প্রকল্প পাহারার কাজে সন্ত্রাসী লালনপালন করেন। সুমনের কাছে হত্যাকাণ্ডের জন্য টাকা পৌঁছে দেয় টিটু। হত্যাকাণ্ডের ৫ দিন আগে আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে বসে সন্ত্রাসী তাহের ও সুমনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যাকাণ্ড সংঘটনের দায়িত্ব দেওয়া হয় সুমনকে। হত্যার আগের দিন অর্থাৎ গত ১৫ মে সুমন, বাবুসহ কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন ছক করে। সুমনের নেতৃত্বে অন্তত ১০ থেকে ১২ জন সক্রিয়ভভাবে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যুক্ত ছিল। ১৬ মে তারা পল্লবীর ঘটনাস্থলে একত্রিত হয়।

গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আহসান খান জানান, গত বুধবার থেকে সাহিনুদ্দিন হত্যামামলার তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা মিরপুর জোনাল টিম। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গত বুধবার রাতে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলায় যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রকির নাম এজাহারে নেই। রকি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য চারজনকে ভাড়া করেছিল।

এর আগে এক বছর আগেও সাহিনুদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করে সুমন বাহিনী। ওই ঘটনায়ও মামলা করেছিলেন সাহিনুদ্দিনের মা। সেই মামলায়ও অধিকাংশই আসামি বর্তমান হত্যামামলার; কিন্তু এতদিন কারও কোনো শাস্তি হয়নি। মামলার বাদী আকলিমা বেগম জানান, পল্লবীর উত্তর কালসীর সিরামিক এলাকার বাসিন্দা আকলিমার দুই ছেলের মধ্যে সাহিনুদ্দিন ছোট। বড় ছেলে মাঈনুদ্দীন। বাউনিয়া মৌজার উত্তর কালসীর বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকায় ১০ একর জমি রেখে গেছেন আকলিমার প্রয়াত স্বামী। গত বছরের জুলাইয়ে তার স্বামীর মৃত্যুর পর জমিটি দখল করতে তার দুই ছেলেকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সেজন্যই গত বছরের নভেম্বরে তার দুই ছেলের ওপরই হামলা হয়েছিল। সাহিনুদ্দিন ও মাইনুদ্দিনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে গত বছরের ২৬ নভেম্বর মামলা করেছিলেন আকলিমা; কিন্তু জামিনে বের হয়ে আসামিরা এতদিন এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলছিল; দুই ছেলেকে হত্যার হুমকি দিত। এ নিয়ে সব সময় ভয়ে থাকতেন তারা।