গাজীপুরে তুরাগ নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে কালিয়াকৈর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম। নদী শাসনের মাধ্যমে ভাঙনের কবল থেকে গ্রামগুলোকে রক্ষা করার জন্য প্রধান মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের নন্দীচালা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তুরাগ নদী। এ নদীর তীরেই ছিল নকুল চন্দ্র বর্মনের বাড়ী। এক বছর আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় তার বাড়ীঘর ও জমিজমা। মৎসজীবী নকুল চন্দ্র বর্তমানে তার পরিবার নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরের ভান্নারা এলাকায় ভাড়া বাসায় বাস করছেন। শুধু নকুল চন্দ্র নয়, তার প্রতিবেশী ভবেন্দ্র মালো ও রবেন্দ্র মালোর বাড়ীরও অর্ধেক চলে গেছে তুরাগের গর্ভে। গ্রামটির প্রায় পঁচিশটি বাড়ী এখন চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। নদীটিতে হঠাৎ করে ব্যাপক ভাঙন শুরু হওয়ায় ইতোমধ্যে ফসলের অনেক জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। যেকোন সময় তাদের ঘর বাড়ীও নদীগর্ভে চলে আশংকা রয়েছে।এজন্য ভয় ও শংকার মাঝে দিন কাটছে তাদের। নদী শাসনের মাধ্যমে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর কয়েক মাস আগে আবেদন করা হলেও এখনও পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা কোন পদক্ষেপ নেন নি।

সরেজমিনে এলাকাটি পরির্দশনে দেখা যায়, কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মধ্য দিয়ে তুরাগ নদীটি বয়ে গেছে। এ ইউনিয়নের রঘুনাথপুর বাজার থেকে পূর্বদক্ষিন দিকে চরবাড়ী এলাকা পর্যন্ত নদী তীরের দুই কিলোমিটার এলাকাটি খাড়া ঢালু বিশিষ্ট। এখানে রয়েছে নন্দীচালা গ্রামটি, যেখানে প্রায় পঁচিশটি পরিবার বাস করে নদীর তীরবর্তী এলাকায়। গত বছরের জুন জুলাইয়ের দিকে হঠাৎ করেই নদীটির তীরবর্তী এলাকা ভাঙতে শুরু করে। ব্যাপক ভাঙনের মুখে নদী তীরের প্রায় ২০ থেকে ২৫ ফুট এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এসময়ই নকুল চন্দ্রের বাড়ী ও জমি নদী গর্ভে চলে যায়। ক্রমানন্বয়ে ভাঙনের ফলে এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। নদীতে ভবেন্দ্র মালো ও রবেন্দ্র মালোর বাড়ীরও অর্ধেক চলে গেলে আত্কং বেড়ে যায় এখানে বসবাসকারী লোকদের মাঝে। বর্তমানে এখানকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উৎপল রক্ষিতের বাড়ীসহ প্রায় ২৫টি বাড়ী ভাঙনের মুখে রয়েছে। বৃষ্টি বা বর্ষা মৌসুম শুরু হলে কোনভাবেই এসব বাড়ীঘর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে ধারনা এলাকাবাসীর। তাই যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন তারা।

ব্যবসায়ী উৎপল রক্ষিত জানান, এখানে বসবাসরত বেশীর ভাগ লোকজনই আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়। একসময় নদী থেকে মৎস আহরন করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমানে নদীতে কোন মাছ না থাকায় এলাকার বিভিন্ন মৎস খামারে মাছ ধরে তারা জীবীকা নির্বাহ করেন। ফলে নদীর খাড়া তীরটিতে নিজেদের উদ্যোগে অস্থায়ী কোন বাঁধ বা ভাঙন ঠেকানোর কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাপ দাদার ভিটে মাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেলে তারা ভূমিহীন ও বাস্তুভিটাহীন হয়ে পরবে। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্রুত কোন ব্যবস্থা গ্রহন করলে তাদের ঘরবাড়ী ও জমি নদীর গ্রাস থেকে রক্ষা পেত।

নদী ভাঙনে বসতবাড়ীহারা নকুল চন্দ্র বর্মনের স্ত্রী শিখা রাণী বর্মন এসেছেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করতে। এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, দীর্ঘদিনের বসতবাড়ী নিজ চোখের সামনে নদীতে ভেসে যায়। ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে কোনমতে নিজেরা রক্ষা পেলেও সকলকিছু হারিযে যায় নদীতে। মাঝে মধ্যে এখানে আসি প্রতিবেশীদের ও আতœীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। তখন মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ যদি যথাসময়ে কোন পদক্ষেপ নিত , তাহলে আমরা নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতাম। নদী ভাঙতে ভাঙতে একেবারে বসত ঘর ছুঁই ছুঁই করছে শ্রী রামচন্দ্র মালো ও প্রাণ বল্লব মালোর। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন আরো ১০/১২ জনকে সাথে নিয়ে, যাদের সবার ঘরই ভেঙে নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তারা জানান, বর্ষা শুরুর আগেই যেভাবে নদী ভাঙছে, তাতে এবারের বর্ষায় হয়তো আমরা বসতবাড়ী রক্ষা করতে পারব না। আমরা ইউএনও, ডিসি স্যারের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছি, কিন্ত এখনও কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তারা। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের নিজেদের কোন সামর্থ নেই এ ভাঙন প্রতিরোধ করার জন্য। সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করলে আমরা বাস্তুহারা হয়ে যাব, নিঃস্ব হয়ে যাব।

এ ব্যাপারে বেসরকারী সংস্থা বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোঃ মনির হোসেন জানান, আমরা এক মাস আগে এলাকাটি সরেজমিনের ভিজিট করেছি। যেভাবে নদীর তীর ভাঙছে, তাতে সর্বপ্রথম এলাকাটির বাড়ীঘর ও মানুষকে রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষনিকভাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। তারপরে নদী ভাঙনের প্রকৃত কারন অনুসন্ধান করে স্থায়ী ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া, নদীর পানি ধারন ক্ষমতা বাড়াতে পরিকল্পিত খনন কাজ করতে হবে, নদী থেকে বালি উত্তোলন ও পাড় কেটে মাটি নেওয়া বন্ধ করতে হবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (নরসিংদী) এর উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা আবেদনপত্র পেয়েছি। খুব শীঘ্রই ভাঙন প্রবন এলাকাটি পরিদর্শন করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো। গুরুত্ব বিবেচনা করে জরুরীভাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা দরকার হলে , তা নেওয়া হবে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।