আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পর এবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বৃহষ্পতিবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।

মন্ত্রী বলেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ থেকে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে বৃহষ্পতিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারস্থলে একজনকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী করা হচ্ছে। এর আগে তিন সদস্যের একটি প্যানেল মেয়র গঠন করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতায় যিনি এগিয়ে আছেন তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পত্রপ্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে নতুন ভারপ্রাপ্ত মেয়র দায়িত্ব নিবেন। এরইমধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। আইন অনুযায়ী এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি কর্পোরেশন-২ শাখা থেকে বৃহষ্পতিবার জারী করা এক অফিস আদেশে জানাগেছে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের জন্য তিন সদস্যের মেয়রের একটি প্যানেল গঠণ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। আইন অনুযায়ী প্যানেলে স্থান পেয়েছেন সাধারণ দুই ওয়ার্ডের দুইজন কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একজন নারী কাউন্সিলর। যে তিনজন কাউন্সিলর মেয়র প্যানেলে মনোনয়ন পেয়েছেন তারা হলেন- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৪৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ, ৫২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোঃ আব্দুল আলীম মোল্লা এবং ১০ নং সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট মোসা. আয়েশা আক্তার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করায় ওই প্যানেল থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে একজন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

সূত্র জানায়, উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়েছে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯- এর ধারা ২০(২)- এর বিধান অনুযায়ী গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ওই তিন কাউন্সিলরের সমন্বয়ে ৩সদস্যের একটি মেয়রের প্যানেল মনোনীত করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের আইনের ২০(১) নম্বর ধারায় বলা আছে, সিটি কর্পোরেশন গঠন হওয়ার পর অনুষ্ঠিত প্রথম সভার এক মাসের মধ্যে কাউন্সিলররা অগ্রাধিকারক্রমে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তিন সদস্যের একটি মেয়রের প্যানেল নির্বাচন করবেন। এই তিনজনের মধ্যে একজনকে অবশ্যই নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হতে হবে। এই ধারা অনুযায়ী মেয়রের প্যানেল নির্বাচন করা না হলে ২০(২) ধারা অনুযায়ী সরকার সেটি গঠণ করে দিতে পারবে বলে উল্লেখ করা আছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জায়গা দখল, অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণ না দেয়া, জনগণের স্বার্থ পরিপন্থীসহ বেশ কিছু অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে দাখিল হয়েছে। সেসব অভিযোগ পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে তদন্তের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে যদি তা তদন্ত বা নিষ্পত্তির জন্য আমলে নেওয়া হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী ওই জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করার নিয়ম রয়েছে। আর সে কারনেই সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যদি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।

মন্ত্রী আরো বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। তদন্তে যেসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে সে অনুযায়ী তাকে শো’কজ করা হবে। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার ভোগ করতে পারবেন। সাংবিধানিকভাবে সে অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কারের পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন মোঃ আতাউল্লাহ মন্ডল। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গাজীপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক পদ শূন্য হওয়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মো: আতাউল্লাহ মন্ডলকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে গত ১৯ নবেম্বর গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়াামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। একইসঙ্গে দলে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে। এতে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ শূন্য হয়।

এ ব্যাপারে মোঃ আতাউল্লাহ মন্ডল জানান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহ দপ্তর সম্পাদক দুপুর একটার দিকে তাকে মোবাইল ফোনে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টি জানান। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা আমার উপর আস্থা রেখে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমি সৎ ও নিষ্টার সঙ্গে পালন করব। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি আরো বলেন, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দলকে এগিয়ে নিতে সর্বাত্মকভাবে কাজ করব। তিনি সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ছিলেন আতাউল্লাহ মন্ডল। এর আগে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রায় ৩০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন।

প্রসঙ্গতঃ গত ২২ সেপ্টেম্বর মেয়র জাহাঙ্গীরের ঘরোয়া আলোচনার একটি রেকর্ড ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এর একটি অংশ ছিল ভিডিও, একটি অংশ ছিল অডিও। আলোচনার রেকর্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর আওয়ামী লীগের একটি অংশ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দলীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে বিক্ষোভে নামে। সেসময় মেয়র ছিলেন দেশের বাইরে। ফেসবুকে রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ার পর মেয়র জাহাঙ্গীরের শাস্তির দাবিতে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে গাজীপুর ছিল উত্তপ্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরের ব্যাখ্যা চায় আওয়ামী লীগ। এতে তাকে ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। ১৮ অক্টোবর সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই মেয়র তার ব্যাখ্যা দেন। গত ১৯ নবেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সঙ্গে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়।