শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ হানিফের ৫১তম শাহাদত বার্ষিকী বৃহষ্পতিবার (২৬ মে)। তাঁর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে শুক্রবার বাদ জু’মা নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার সিংসারা পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৪১ইং সালের ১৬ই জুন ভোলা সদর উপজেলার পশ্চিম চরনোয়াবাদ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মোহাম্মদ হানিফ। ¯œাতক পাশের পর তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) যোগদান করেন। কর্মজীবনে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে তিনি ওই ব্যাংকের নওগাঁও জেলার আত্রাই থানাধীন আহসানগঞ্জ শাখার ম্যানেজার নিযুক্ত হন। ওই শাখার দায়িত্ব নিয়ে তিনি স্ব-পরিবারে থাকতেন আত্রাই রেলস্টেশন সংলগ্ন এক বাসায়।

‘অহিদুর বাহিনী’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের প্রধান সাবেক সংসদ সদস্য মোঃ অহিদুর রহমান জানান, ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে এবং তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর আর্থিক সহায়তা করেছেন বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত মোহাম্মদ হানিফ। অন্য এলাকার মানুষ হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার সমর্থন, ভালবাসা, মুক্তিযুদ্ধ কালে তার সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অর্থ সহায়তার বিষয়টি স্থানীয় রাজাকার মজিদ মোল্লার অনুসারীরা আত্রাইতে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়।

এদিকে যুদ্ধ চলাকালে ব্যাংকের নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে কি-না তা জানতে পাকসেনারা ওই ব্যাংক ম্যানেজার মোহাম্মদ হানিফের অফিসে আসে। ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনার পর যাওয়ার সময় তারা ভুল বশতঃ হানিফের অফিসে একটি মানচিত্র (ম্যাপ) ফেলে যায়। মানচিত্রটি মুক্তিযোদ্ধদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ব্রিজ-কালভার্ট, মন্দির, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সম্বলিত ছিল। ওই মানচিত্রের অবস্থান অনুযায়ী সেগুলো পাকসেনাদের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু ছিল। মানচিত্রটি হাতে পেয়ে তা আত্রাই-সিংসারা এলাকার ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল আজিজ খানের কাছে পৌছে দেন হানিফ। এই মানচিত্র পাওয়ার পর ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পাক সেনাবাহিনী সম্পর্কে সতর্ক হতে প্রভ’ত সহায়ক হয়েছে।

ইতোমধ্যে ওই মানচিত্রটির খোঁজ পড়ে পাক সেনাদের। তারা ওই মানচিত্রের খোঁজে হানিফের অফিসে আসে। হানিফ তার অফিসে এ ধরনের কোনো মানচিত্র পাননি বলে জানিয়ে দেন। কিন্তু পাক সেনাদের বার বার একই কথা, তারা মানচিত্রটি ব্যাংকেই রেখে গেছে। শেষে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে বলে মানচিত্র আমরা ব্যাংকেই রেখে গেছি, সেটি বের করে দিতে হবে তোমাকে। নতুবা এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। আর এখান থেকেই শুরু হয় একটি বিয়োগান্তর ঘটনার।

মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অর্থ প্রদান ও পাক সেনাদের মানচিত্রের বিষয়ের ঘটনার পর পাক সেনারা হানিফের পেছনে গোয়েন্দা নিয়োজিত করে তার গতিবিধি এবং কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে অনুসন্ধানের পর একসময় তারা ঠিকই অনুমান করতে পারে যে, হানিফ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে চাকরি করলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এরপর শুরু হয় তাকে হত্যার পরিকল্পনা। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে হানিফ বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। এ অবস্থায় তিনি ১ মেয়ে, ২ ছেলে এবং অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ তার পরিবার রেখে আসেন আত্রাই শহর থেকে প্রায় ৪ কি.মি. দূরে সিংসাড়া গ্রামের মকবুল চেয়ারম্যানের বাড়িতে। এরপর শুরু হয় হানিফের যাযাবর জীবন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করতে থাকেন। মাঝে মধ্যে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসতেন। ১৯৭১ এর ২৬শে মে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার পর চেয়ারম্যানের বাড়িতে বসেই ৩৫ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে বৈঠক করেন। এ সংবাদ রাজাকারদের মাধ্যমে পাক সেনাদের কাছে পৌঁছে যায়। সংবাদ পেয়ে রাতেই পাক সেনারা পায়ে হেঁটে গিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। ঘেরাও আঁচ করতে পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট ভাই আত্রাই কলেজের তৎকালীন ভিপি এবং বিশিষ্ট ছাত্রনেতা মুজিবুর রহমান পাক সেনাদের প্রতি গুলিবর্ষণ করেন। শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ। দীর্ঘক্ষণ গুলিবিনিময়ের পর মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে পাকসেনারা। পরে হানিফসহ ওই ৩৫ মুক্তিযোদ্ধকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার পরও তারা হানিফের পেটে বেয়নেট চার্জ করে নাড়িভূঁড়ি বের করে ফেলে। যখন তারা নিশ্চিত হলো অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় হানিফ মারা গেছেন, তখন তারা চলে যায়।