বাঙালি নারীর জন্য শাড়ি মানেই হচ্ছে এক সৌন্দর্যের ব্যাকরণ। ‘শাড়ি’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্রই বাঙালি রমণীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যে কোনো উৎসবে শাড়ি ছাড়া নারীর সাজগোজ যেন অপূর্ণই থেকে যায়। বাঙালি নারীর সবচেয়ে নান্দনিক পোশাক শাড়ি। আবহমান কাল থেকে শাড়ি বাঙালি নারীর সম্ভ্রম, অলঙ্কার আর অহংকার। ছবি : মডেল ও অভিনেত্রী শাহলা ইসলাম তমা ।

জন্মের পর থেকে আমার চারপাশে যতো মমতাময়ী মুখ মা, দাদি, নানি, ফুপু, খালা সবার পরনেই রঙ বেরঙের শাড়ি দেখে আসছেন। ছোটবেলায় মায়ের শাড়ি পরেননি এমন মেয়ে কমই আছেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আলমারিতে নিজের শাড়ি। বাঙালি নারী আর শাড়ি যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।

যুগ পরিবর্তনের হাওয়াতে সবকিছু বদলে গেলেও বাঙালি নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশের জায়গায় এখনও চিরায়ত বাংলার শাড়ি দখল করে আছে অদ্বিতীয় মাত্রায়। এখন মেয়েদের বয়স পাঁচ ছয় হলেই শাড়ি পরতে হয় না। তবে উৎসব আয়োজনে শাড়ি থাকে নারীদের পছন্দের পোশাকের তালিকায় সবার প্রথমে। জীববৈচিত্র্যের মতো লক্ষ্য করা যায় বস্তু-বৈচিত্র্য। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেই হারিয়ে যেতে হয় ইতিহাসের পাতায়। শাড়ি সেখানে ব্যতিক্রমী এক নাম। সেই পুরাকাল থেকে এখনও বজায় রেখেছে নিজের গরিমা। বাঙালি নারী দেহে এক অবিসংবাদী পরিধেয়।

নারীর পরিধেয় বস্ত্র শাড়ির ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩ হাজার বছর বা তারও আগে থেকে রয়েছে শাড়ির উল্লেখ। বিভিন্ন নারী মূর্তির পরনে শাড়ি জড়িয়ে রাখার চল ছিল বলে মনে করা হয়। অবশ্য এখন শাড়ি বলতে আমরা যা বুঝে তার থেকে কিছুটা আলাদা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আগে নারীরা এক টুকরো দীর্ঘ বস্ত্র সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রাখতেন, সেটাই ছিল শাড়ি। ছিল না ব্লাউজ পেটিকোটের বালাই। তাও সমাজের নিম্ন আয়ের পরিবারেই ছিল এই পোশাকের প্রচলন। সেই শাড়িই কালক্রমে হয়ে দাঁড়ালো বাঙালি নারীর আভিজাত্যের পোশাক।

মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় ‘শাড়ি’কে আরও বিভিন্ন শব্দে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেমন-‘সাটক’, ‘সাটিকা’। আবার ‘মহাভারত’য়ে উল্লিখিত দ্রৌপদীর যে ‘বস্ত্রহরণ’ করা হয়েছিল, সেটাও অনুমিত হয়, শাড়িই ছিল। গুপ্ত যুগের (আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ সাল পর্যন্ত) বিখ্যাত কবি মহাকবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, অজন্তা ইলোরারর গুহাচিত্রেও মেলে শাড়ির প্রচলনের ইঙ্গিত। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকেও শাড়ি বলে চিত্রায়িত করা হয়ে থাকে।

গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ইলোরা অজন্তার মতো পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির প্রচলন ছিল। তবে এসব শাড়ি পরার সঙ্গে আজকের শাড়ি পরার খানিকটা পার্থক্য রয়েছে।

শাড়ি শব্দের উৎপত্তি কোথায়? যেহেতু এই বস্ত্রের ইতিহাস অতি দীর্ঘ, তাই শব্দটির জন্মবৃত্তান্তকে ঘিরে রয়েছে একাধিক মতবাদ। কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত শব্দ ‘শাটী’ থেকে ‘শাড়ি’র উৎপত্তি হয়েছে। বহু ইতিহাসবিদ এই তত্ত্বকে মানতে নারাজ। তারা দাবি করেন, ‘শাটী’ নিজেই তো সংস্কৃতের মৌলিক সম্পদ নয়, তাহলে ‘শাড়ি’র উৎপত্তি-শব্দ হচ্ছে কেমন করে? আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই নাকি ‘শাটী’ শব্দটির অস্তিত্ব ছিল।

সমগ্র ভারত এবং পূর্ববঙ্গ জুড়ে চোখে পড়ে শাড়ির রকমফের। অঞ্চলভেদে যেমন পোশাকটির ধরণ বদলেছে, তেমনই পরার ধরনও। আবহাওয়ার ওপরেও নির্ভর করে পোষাকের বিভিন্নতা। গ্রামবাংলার শাড়ি এবং মধ্য, দক্ষিণ ভারতে শাড়ি পরার ধরণ পৃথক পৃথক। শাড়ি পরার ধরণ দেখে বলে দেয়া যায় মানুষটি দেশের কোনো প্রান্তের। তবে পুরাকালের মতো এখনও একটি ক্ষেত্রে মিল রয়ে গিয়েছে। প্রথম দর্শনে শাড়ি বলতে মনে হয় দীঘল কোনো বস্ত্র। যা সারা দেহের লজ্জা নিবারণে সমর্থ।

ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হত ‘ধূতি’, আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’। নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরের ওপরের অংশ উন্মুক্তই থাকত। তবে কখনও কখনও উচ্চবংশের নারীরা পালা-পার্বণে ওড়নাজাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিত।

রামচন্দ্র মজুমদারের কথায় এর সমর্থনও পাওয়া যায়- ‘তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার- এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরেছে। ওপরে জড়ানো থাকত আধনা বা আধখানা।’

মধ্যযুগের কবিদের কাছ থেকে শুধু শাড়ির কথাই জানা যায় না, শাড়ির রংয়ের কথাও জানা যায়। চৌদ্দ শতকের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন— ‘নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ।’

প্রথম মা হওয়া নারীকে উপহার হিসেবে দেয়া হত লাল শাড়ি। শাড়ি পরার ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বিভাজন ছিল। ধনী নারীদের শাড়ি ছিল মলমলের মিহি কাপড়ের। আর গরিবের শাড়ি ছিল সাধারণ সুতি কাপড়ের; তাও আবার ছেঁড়া। প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করা সুইয়ে তালি দেয়া শাড়ি পরতে হত তাদের।

মুসলমানরা ভারতবর্ষে আগমনের ফলে এখানকার পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। তুর্কি-আফগান-মোগল সংস্কৃতির ধারা স্থানীয়রাও গ্রহণ করেছিল। পাগড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পায়জামার মতো পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শাড়ির গুরুত্ব কমে যায়নি। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে।

মারুফ সরকার
ঢাকা