স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আজীবন জাতীয় স্বার্থে পক্ষে, জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিপীড়িত গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছেন। তার রাজনীতি ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণে। আজ থেকে ৪৮ বছর পূর্বে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার মানুষ ধীরে ধীরে পানির অধিকার খেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর এই কারণেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের শুরুতেই তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
ফারাক্কায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীকে অবমুক্ত করার সুমহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ১৯৭৬ সালে তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল “ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ’’। সে সময় তিনি মানুষের নেতা হিসেবে সাধারণ মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শাশ্বত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।’
উনিশশো ছিয়াত্তর সালের ১৬ই মে ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের দিকে একটি মিছিলের আয়োজন করেন বাংলাদেশের সুপরিচিত রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এই মিছিল ও সমাবেশ ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ হিসেবে পরিচিত। মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ সংগঠিত করা। তিনি যখন ফারাক্কা লং মার্চের নেতৃত্ব দেন তখন তার বয়স ৯৬ বছরের বেশি।
১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে মাওলানা ভাসানী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৯৭৬ এর ১৮ই এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে তিনি লংমার্চ করবেন। তাঁর এই কর্মসূচী তখন বিশ্বকে বেশ চমকে দিয়েছিল। কারণ ৯৬ বছরের একজন মানুষের ঘরেই থাকার কথা। অথচ, সেই প্রবীণ বয়শে তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে ১৬ই মে রাজশাহী শহর থেকে লংমার্চ করার ঘোষণা দেন।
১৯৭৬ সনের ২৪ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী বলেন যে, অভিন্ন নদীর পানি কোনো দেশ এককভাবে পেতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সুতরাং এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যাবে না। ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের পানি প্রবাহ রুদ্ধ করতে চায়। তিনি তাঁর বক্তব্যে সরকারের প্রতি বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনের আহ্বান জানান। এর প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ২০ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, আমরা সময় মতো পানি না পেলে আমাদের কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সেচ বন্ধ হয়ে যাবে। এদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন মরণ সমস্যা হচ্ছে। ভারতের অবস্থান আমাদের উজানে হওয়ায় তারা এ সুযোগ গ্রহণ করেছে। ভারত যদি একতরফাভাবে কোনো আন্তর্জাতিক নদী নিয়ন্ত্রণ করে শুষ্ক মৌসুমে সে পানি নিয়ন্ত্রণ পূর্বক বাংলাদেশকে চরম ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যায় দেশ ভাসিয়ে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ভারত শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গতভাবে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করুক এটাই আমরা চাই। না হলে ভারতের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করা হবে।
কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৬ সালের ২রা মে মাওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়। এর পরে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে কমিটির সংখ্যা ৭২ জনে উন্নীত করা হয়। ফারাক্কা লংমার্চ সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ন্যাপ’র তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক জাতীয় নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া।
এই লংমার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লিখেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সে চিঠিতে মিসেস গান্ধির কাছে লংমার্চের কারণ বর্ণনা করেন ভাসানী। সাংবাদিক এনায়েতউল্লাহ খান, আনোয়ার জাহিদ এবং সিরাজুল হোসেন খান এ চিঠি তৈরি করতে আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সহায়তা করেন।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীর প্রেরিত পত্রের জবাবে লিখেছিলে-“এটি ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও বেদনাকে একই ভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি বর্তমানে আমাদেরকে এত বেশী ভুল বুঝেছেন, এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।”
ইন্দিরা গান্ধীর পত্র প্রাপ্তির পর মওলানা ভাসানী আবারো ইন্দিরা গান্ধীকে লিখেছিলেন, “আপনার ৪ মে’র পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপূরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে আমার এরূপ প্রত্যাশা ছিলনা। ফারাক্কা সম্পর্কে আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সফর করে আমাদের কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তা নিরুপণ করার জন্য। আমি আপনাকে সরকারি কর্মকর্তাদের রিপোর্টের উপর আস্থা স্থাপন না করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ এগুলো প্রায়ই বিদ্যমান অবস্থার প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন নয়। পারস্পারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানে আপনার পথকে আমি প্রশংসা করি। তবে সমস্যার ব্যাপক ভিত্তিক স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দু’মাসের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বণ্টন ভিত্তিক হওয়া উচিৎ।”
লংমার্চ সফল করার জন্য ১৯৭৬ সালের ২৮শে এপ্রিল মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে সকলের প্রতি আহবান জানান।
জাতীয় কৃষক সমিতির নেতা আবু নোমান খান সে লংমার্চ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন মজলুম জননেতা: মাওলানা ভাসানী স্মারক সংকলন’ বইতে। সেখানে তিনি বলেন, ” লংমার্চের মিছিল রাজশাহী থেকে প্রেমতলী, প্রেমতলী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মনকষা এবং মনকষা থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত ৬৪ মাইল অতিক্রম করবে।”
উনিশশো ছিয়াত্তর সালের ১৬ ই মে রাজশাহী শহর থেকে ফারাক্কা অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। হাজার-হাজার মানুষ সমবেত হয় সেই মিছিল ও জনসভায়।
৪৮ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী যা অনুমান করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটিই ঘটেছে। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী উদ্ধৃতি করে ১৯৯৫ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝে নাই।”
রাজশাহী শহরে তখন অচেনা মানুষের ভিড়। লংমার্চে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সর্বস্তরের মানুষ আসছে। রাস্তায় রাস্তায় লাউড স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছে – ১৬ই মে রোববার মাদ্রাসা মাঠ থেকে লংমার্চ শুরু করবে। বাসা থেকে বেতার ভবনে যাওয়ার সময় দেখলাম পথঘাট লোকে লোকারণ্য। বিশাল মাদ্রাসা মাঠে ভীড় উপচে পড়ছে। ”
সেই লংমার্চের খবর সংগ্রহ করতে রাজশাহী গিয়েছিলেন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের জন্য খবরা-খবর পাঠাতেন। তিনি তার স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘পথ থেকে পথে’ বইতে সেই লংমার্চের বিষয়ে বর্ণনা করে লিখেছেন, “মিছিলের আগে মাদ্রাসা ময়দানে জনসভা। ভাসানী এলেন নীল গাড়িতে চেপে। জনসমুদ্র গর্জে উঠল। খুব অল্প সময়ের জন্য তিনি বকৃতা করলেন। বহু সাংবাদিক, বহু ফটোগ্রাফার।” লংমার্চের ৬৪ কিলোমিটার যাত্রা ছিল বেশ কঠিন। সবচেয়ে বড় আশংকা ছিল মওলানা ভাসানীকে নিয়ে। এমনিতেই তার বয়স ৯৬ বছরের মত। তার উপর কিছুদিন আগেই তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
‘মাওলানা ভাসানীর জীবনস্রোত’ শিরোনামে একটি লেখায় সেই লং মার্চ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন জাতীয় কৃষক সমিতির সাবেক সপ্তর সম্পাদক আবু নোমান খান। তিনি লিখেছেন, “মিছিলের শুরুতে ভাসানীসহ নেতৃবৃন্দ পুরোভাগে দাঁড়ান। মিছিলটি তিন মাইল দুরে রাজশাহী কোর্ট এলাকায় যেতে না যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামে। তা সত্ত্বেও লক্ষ জনতার মিছিল এগিয়ে চলে। এগারো মাইল অতিক্রম করে প্রেমতলী পৌঁছে। তখন দুপুর দুটো,” লিখেছেন আবু নোমান খান।
সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল তিনটা নাগাদ লংমার্চ আবারো যাত্রা শুরু করে। এরপর প্রায় ২০ মাইল পথ অতিক্রম করে রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছে মিছিলটি। রাতে সেখানেই তারা অবস্থান করেন। পরদিন সকাল আট ৮ টায় আবারো যাত্রা শুরু করে লংমার্চ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আরো ছয় মাইল পথ অতিক্রম করে কানসাট পৌঁছায় দুপুরের মধ্যে মিছিলটি পৌঁছে কানসাটে। “পথের দুধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে হাজার-হাজার মানুষ – উদ্দেশ্য ফারাক্কা লং মার্চ-এর মিছিলকারীদের অভ্যর্থনা জানানো। মিছিলকারীদের পানি ও বিভিন্ন খাবার খাইয়েছেন তারা। ” “বিকেল চারটার দিকে সেখানে জনসভায় বক্তব্য রাখেন মওলানা ভাসানী। সে জনসভায় তিনি বলেন, ফারাক্কা সমস্যার সমাধানের জন্য ভারত যদি বাংলাদেশের মানুষের দাবি উপেক্ষা করে তাহলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হবে।
পলিমাটি জমে কলকাতা বন্দরের গভীরতা কমে যাওয়ায় কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ১৮ মাইল উজানে মনোহরপুরের কাছে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীতে পানি প্রবাহ বাড়ানো। সেজন্য গঙ্গা নদী থেকে বিপুল পরিমাণ পানি ভাগীরথী-হুগলী নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে করে সেখানে জমে থাকা পলিমাটি পানিতে ভেসে যায় এবং কলকাতা বন্দরের গভীরতা বজায় থাকে।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক বৈঠকে একমত হন যে শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দুই দেশ একটি চুক্তিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না। কিন্তু ভারত সে কথা রাখেনি। উনিশশো পঁচাত্তর সালের শুরুর দিকে ভারত বাংলাদেশকে জানায় যে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানেল পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পঁচাত্তরের সালের ২১ শে এপ্রিল থেকে মাত্র ১০ দিনের জন্য এটি পরীক্ষার কথা বলেছিল ভারত। এতে বাংলাদেশ রাজী হয়। কিন্তু এরপরেও ভারত একতরফাভাবে গঙ্গানদীর গতি পরিবর্তন করে।
২০১৬ সালে ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে দেয়ার দাবি করেছেন। সেই প্রথম একজন ভারতীয় রাজনীতিক এরকম মন্তব্য করলেন বটে কিন্তু শুরু থেকেই এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিলেন নদী বিশেষজ্ঞরা। ফারাক্কার প্রভাবে নদীর স্বাভাবিকতা হারিয়ে গঙ্গার উজানে বিহার ও উত্তর প্রদেশ এবং ভাটিতে সুন্দরবন পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। নীতিশ কুমার ফারাক্কা ভাঙার প্রস্তাব দিলেও সে ব্যাপারে বিশেষ কিছু করেননি।
সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপলের কর্ণধার ও নদী-বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠক্করও বলেছেন, একটা বাঁধ ডিকমিশন করার আগে কয়েকটা জিনিস খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয় – দেখতে হয় লাভ-ক্ষতির পাল্লাটা কোন দিকে ভারী। ফারাক্কার ক্ষেত্রে সেই স্টাডিটা এখনও শুরু করা হয়নি। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট – ফারাক্কার মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল সেই কলকাতা বন্দরকে কিন্তু আজও বাঁচানো যায়নি।
বিভিন্ন তথ্য মতে, কলকাতা বন্দর টিঁকিয়ে রাখতে আজ যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয়, ফারাক্কা চালু হওয়ার আগেও ততটা করতে হত না। এটাকে একটা প্রতীক ধরলে ফারাক্কা তো ভেঙে ফেলাই উচিত। ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর রেল ও সড়ক-সেতু এখনকার মতো রেখে দিয়েই ব্যারাজটা সরিয়ে দেওয়া সম্ভব – ইউরোপ আমেরিকাতে তা অনেক জায়গাতেই হয়েছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ সুমনা ব্যানার্জিও বলেছেন, ফারাক্কার জন্য গঙ্গায় এত বেশি পলি জমছে যে তাতে দুপারের জমি ভাঙছে, জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। ভারতের জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী – তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে।
প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো ফারাক্কা ব্যারাজ যে ভারতের আর বিশেষ কোনও কাজে আসছে না – বরং নানা ধরনের পরিবেশগত বিপদ ডেকে আনছে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই তা খোলাখুলি বলছেন।
বাংলাদেশ থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতে গঙ্গা নদীতে বিতর্কিত ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর পর গত পাচ দশকে যেটি গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার উজানে বিপুল পরিমাণ পলি জমে প্রতিবছর বন্যা দেখা দিচ্ছে ভারতের বিহারসহ উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। অন্যদিকে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি আটকে রাখার ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছে ভাটি অঞ্চলে বাংলাদেশ।
এখন বিহারে প্রতি বছর বন্যার জন্য ফারাক্কা বাঁধকেই দায়ী করা হচ্ছে। বিহারে এবার বন্যাতেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ২০ লাখ। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফারাক্কার সমস্যা তুলে ধরে এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান চেয়েছেন বিহারের তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার।
বাংলাদেশের নদীগবেষণা ইনস্টিটিউট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বলেন, ফারাক্কা বাধ দেয়ার আগে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ছিল ৬০ থেকে ৮০ হাজার হাজার কিউসেক। “ফারাক্কা ওদের যে ডাইভারশন ক্যানেল, ব্যারেজের মাধ্যমে তারা ৪০ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নিতে পারে। তো সেটি সরিয়ে নেয়ার পরে যেটি থাকে সেটি পায় বাংলাদেশ।” গঙ্গা চুক্তিতে অন্তত ২৭ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা রয়েছে। তবে চুক্তির আগে অনেক সময় ১০ হাজার কিউসেকেরও কম পানি এসেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, “বিশেষ করে ইলিশ মাছ এবং চিংড়ি মাছের বিরাট ক্ষতি হয়েছে, তাদের প্রজণনে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে সংখ্যা কমে গেছে এছাড়া অন্যান্য মাছেরও ক্ষতি হচ্ছে। আর উপকূল এলাকায় মানুষ একটা মিষ্টি পানির ওপর নির্ভরশীল যাদের জীবন, সেটা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
১৬ মে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল-লংমার্চ হয়েছিল এই দিনে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। সেটা ৪৮ বছর আগের কথা। আজও ফারাক্কা সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারত তিস্তা চুক্তি করতে গড়িমসি করছে। ভারতের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ একে অপরের প্রতি দোষারোপ করে যাচ্ছে। এ খেলা সকলের কাছে স্পষ্ট।
ফারাক্কা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান হওয়া জরুরি। তা হতে হবে আন্তর্জাতিক আইনসমূহের আওতায়। যতদিন এই সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। ততদিন বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে যাবে। আর এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন এবং থাকবেন মহানায়ক মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এদেশের মানুষ তাঁকে বহু বহুকাল ধরে স্মরণ করবেন।
[লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন]