প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারত ও চীন দুই দেশেরই আগ্রহ আছে। তবে, তিনি চান তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতই বাস্তবায়ন করুক।

চীন সফর শেষে রোববার বিকেলে গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।

মূলত চীন সফর নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নে উঠে আসে তিস্তা প্রকল্প, কোটা বিরোধী আন্দোলন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়গুলোও।

সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কোটা সমস্যার সমাধান আদালতেই হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেয়া হবে না, তবে কেউ ধংসাত্নক কর্মকাণ্ড চালালে আইনি ব্যবস্থা নেবে আইনশৃংখলা বাহিনী।

চীন সফর থেকে নির্ধারিত সময়ের আগে কেন দেশে ফিরে এসেছেন এই সম্মেলনে তার ব্যাখ্যাও দেন শেখ হাসিনা। এই সফলে বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘বাংলাদেশ চীন সফরে কিছু পায়নি বলে যারা বক্তব্য দেয় তারা গুজব ছড়ায়। আমাকে হেয় করতেই এসব গুজব ছড়ানো হয়।’

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা জানান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার কঠোর। অনিয়ম দুর করে সুস্থ্য ধারায় দেশকে আনা হবে।

এছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দেন শেখ হাসিনা।

‘চীন নয়, তিস্তা প্রকল্প ইন্ডিয়া করুক’
সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

শেখ হাসিনা বলেন,‘তিস্তা প্রকল্প আমাদের করতে হবে। এ নিয়ে চীন-ভারত দুই দেশই আমাদেরকে প্রস্তাব দিয়েছিল। এরই মধ্যে চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও সম্ভাব্যতা যাচাই করবে।’

‘দুই দেশের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে আমরা সেটা নেবো।’

তিনি বলেন,‘তবে আমি এখানে বেশি প্রাধান্য দেবো যে এটা ইন্ডিয়া করুক। কারণ তিস্তার পানিটা ইন্ডিয়া আটকে রেখেছে। তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের আদায় করতে হয় তাহলে এই প্রজেক্টের কাজ তাদেরই করা উচিৎ। তারা প্রজেক্ট করে যখন যে প্রয়োজন তারা দেবে। এটা তো একটা ডিপ্লোমেসি।’

তিনি জানান,‘এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন তো রেডি, কিন্তু আমি চাচ্ছি এটা ইন্ডিয়া করে দিক। তাহলে এই প্রজেক্টের জন্য যা যা দরকার, ইন্ডিয়া দেবে।’

‘আমাদের দক্ষিণবঙ্গ সব থেকে বেশি অবহেলিত, পদ্মার ওপার। কাজেই এই দক্ষিণ অঞ্চলের ডেভেলপমেন্টের জন্য আমি চীনকে বলেছি। সবথেকে অবহেলিত হওয়ায় ওখানকার কাজগুলো করা কঠিন। কচা নদীর ওপরে একটা সেতু দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা, ওটা চীন করে দেবে।’

‘আমি সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দিছি, কাকে কোথায় দিলে আমার কঠিন কাজ সহজভাবে হবে, ঠিকমতো কাজ করতে পারবো। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’

কোটা আন্দোলন নিয়ে যা বললেন
২০১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবরকম কোটা পদ্ধতি বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল সরকার।

সেই পরিপত্র বাতিল করে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে আন্দোলনে নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ মাসের শুরু থেকে টানা আন্দোলন ও অবরোধের মতো কর্মসূচি চলছে।

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিরের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।

২০১৮ সালে কোটা বাতিল করার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন,‘২০১৮ সালে আন্দোলনের সময় রাস্তায় ধংসাত্নক কর্মসূচি, মানুষের ওপর হামলা, মিথ্যাচারসহ বিভিন্ন কারণে বিরক্ত হয়ে তখন কোটা বাতিল করে দিয়েছিলাম। আর এখন বিষয়টি আদালতের ওপর।’

তিনি বলেন,‘বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আদালত শিক্ষার্থীদের বলেছে তাদের বক্তব্য থাকলে তারা আদালতে গিয়ে বক্তব্য জানাক। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কিছু করার নেই।’

তাহলে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কতদিন চলবে? কিংবা এই আন্দোলনের ভবিষ্যতও বা কী?

জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা আন্দোলন করছে করুক। কোনো ধংসাত্নক কাজ করতে পারবে না। পুলিশের গায়ে হাত দেয়া, গাড়ি ভাঙলে আইন তার নিজ গতিতে চলবে।’

শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?

কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে কোটায় ভর্তি হয়ে এখন কোটার কেন আন্দোলন করছে প্রশ্ন রাখেন শেখ হাসিনা।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?

তবে এই আন্দোলনে কোন মহল ইন্ধন দিচ্ছে কী না সেটি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল শেখ হাসিনার কাছে। তবে এর কোনো জবাব তিনি দেননি।

যদিও গত কয়েকদিন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীরা বলে আসছেন কোটা বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ইন্ধন দিচ্ছে।

‘হাত যখন দিয়েছি, আমি ছাড়বো না’
সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

এসব খবরের পর অনুসন্ধানে নেবে দুদক অবৈধ সম্পদের খোঁজও পাচ্ছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কী হবে, শেখ হাসিনার কাছে এমন প্রশ্ন ছিল সাংবাদিকদের।

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে শেখ হাসিনা তার বাড়ির এই পিয়নের কথা উল্লেখ করে জানান সেই পিয়ন কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন পিয়ন হয়েও।

ওই পিয়ন হেলিকপ্টারে চলাচল করতো জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি জানার পর তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন,‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার কঠোর। হাত যখন দিয়েছি আমি ছাড়বো না। অনিয়ম দুর করে সুস্থ্য ধারায় দেশকে আনা হবে।’

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমি কঠোর হয়েছি বলেই দুর্নীতিবাজরা ধরা পড়ছে। এ সমস্ত জঞ্জাল সাফ করতে হচ্ছে। আমরা খুজে বের করছি বলেই আপনারা জানতে পারছেন।’

উন্নয়ন বাড়ার কারণে দুর্নীতি হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘সারা বিশ্বেই যেখানে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয় তখন কিছু টাকা অপাংতেয়দের হাতে চলে যায়।’

প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিএনপির আমল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছে। ২০১৮ সালের পরবর্তীতে কোটা বিরোধী আন্দোলনের পর কেউ কেউ প্রশ্ন ফাঁস করছে। তাদেরকে ধরা হচ্ছে।

শেখ হাসিনা জানান, প্রশ্ন ফাঁস বা অনিয়মের মাধ্যমে কেউ সরকারি চাকরি পেলে সেটি যদি পরবর্তীতে প্রমাণ হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

‘সমালোচনায় আমার কিছু যায় আসে না’
শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের পর বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিভিন্ন পক্ষ থেকে নানা নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য শেষে এই চীন সফর নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানামূখী সমালোচনা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় শেখ হাসিনার কাছে।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিষয়টিতে খুব গুরুত্ব দেই না। আমি এটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যারা এই কথাগুলো বলে বেড়াচ্ছেন, তারা কি জেনে বুঝে বলছেন, নাকি শুধু আমাকে হেয় করার জন্য বলছেন, সেটাই প্রশ্ন।’

তিন বলেন,‘সমালোচনাকারীরা বলতে বলতে এত বেশি বলে। যারা বলছে বলতে দেন। সমালোচনায় আমার কিছু যায় আসে না।’

এই সফরে বিভিন্ন সমঝতো স্মারকের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হল, ৭টি ঘোষণা এল। তারপরও একটি পক্ষ বলছে এ সফরে নাকি কোনো প্রাপ্তি নেই।

তিনি বলেন,‘চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো। তার আগে ভারত গেলাম, সেখানে বলা হয়েছিল ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে এসেছি। চীনে গেলাম, বলে কিছুই দেয়নি। এগুলো বলেই আসছে। এটা এক ধরনের লোকের মানসিক অসুস্থতা বলে মনে করি।’

‘দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে চীন’
এই সফরে বাংলাদেশের অর্জনের কথা তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকে জিনপিং অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ এ চারটি ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমান অর্থ প্রদানে সম্মত হয়েছে।

পদ্মা সেতু বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বাংলাদেশেল বিভিন্ন বৃহৎ অবকাঠামো নির্মানে চীনের সহযোগিতার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৮০০ একর জমিতে শিল্প বিনিয়োগ করার জন্য প্রেসিডেন্টকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইসিটির বিশেষায়িত অঞ্চলে চীনকে বিনিয়োগের অনুরোধ করা হলে চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে আশ্বাস প্রদান করেছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীনের সহযোগিতার চাওয়া হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই বিষয়ে চীনের সহযোগিতা চাওয়া হলে দেশটির রাষ্ট্রপতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।

আগামী বছর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলভাবে তার কুটনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে।

শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে গবেষণা, শিক্ষা আইসিটি প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সূত্র : বিবিসি