পাবনা সদর উপজেলার টেবুনিয়া বাজারস্থ মালিগাছা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের প্রবেশ পথে ইউপি মার্কেটে বয়লার মুরগী বিক্রি করা ছিল সৈয়দ মুনতাজ আলীর পেশা। ছাত্রাবস্ত্রায় তিনি ছোটখাটো নানা পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এইচএসসি পাশের পর আর পড়ালেখা হয়নি।

আকষ্মিক ভাবে তিনি অল্প সময়ের ব্যবধানে আঙুল ফুলে কলাগাছে রুপ দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার সম্পদ। চাঁদাবাজি, জবরদখল, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, মারধরসহ নানা ত্রাসের সৃষ্টি করেছেন তিনি। সশস্ত্র সন্ত্রাসী গুন্ডা বাহিনী তৈরী করে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

শনিবার দুপুরে পাবনা প্রেসক্লাবের ভিআইপি অডিটোরিয়ামে এক সংকবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান তার ভাইসহ সন্ত্রাসী বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ৫ ইউপি মেম্বার। জীবনের শুরুটা শিবিরের রাজনীতিতে জড়ালেও তিনি পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর রোকন সদস্য হন। পরে দল পরিবর্তন করে বিএনপির রাজনীতিতে আসলেও বর্তমান সময়ে তিনি যুবলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় বলে দাবী করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনতাজ আলী ও তার ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ৫ ইউপি সদস্যের উপর হামলা, মারধর ও হুমকি ধামকি দেয়। তাদের বেধরক পিটুনী ও ছুরিকাঘাতে বর্তমানে ইউপি সদস্য নাহিদ শেখে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশ এখনও আসামী ধরতে পারেনি। সুবিচার চেয়ে এবং চেয়ারম্যানের নানা অনিয়ম, অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে নাহিদ শেখের পরিবার। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইউপির ৭নং ওয়ার্ড সদস্য নাহিদ শেখের বোন রিনা খাতুন।

লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বাররা গত ৯ মাস ধরে সম্মানী ভাতা পান না। চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনতাজ আলীকে বললে তিনি নানা তালবাহানা করেন। গত বুধবার (২৮ আগস্ট) এ নিয়ে পরিষদে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে সদস্যদের কথা কাটাকাটি হয়। সভা শেষে বের হওয়ার সময় চেয়ারম্যান মুনতাজ আলীর নির্দেশে তার ক্যাডার বাহিনী ৫ জন ইউপি সদস্যকে বেধড়ক মারপিট করে। তাদের মধ্যে ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার নাহিদ শেখ কে গুরুত্ব আহত অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে আরো অভিযোগ করা হয়, চেয়ারম্যান মুনতাজ আলীর বাবা ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন দৈনিক হাজিরার শ্রমিক। ইউনিয়ন পরিষদের গলিতে মুনতাজ আলীর একটি ব্রয়লারের দোকান ছিল। অথচ ২০১০ সালের পর থেকে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামীলীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে হরিলুট করে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। টেবুনিয়া বাজারে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি মার্কেট, চারমাইল বাজারের পাশে মার্কেটসহ ১৪ বিঘা জমি, বাড়ির আশেপাশে ৫টি পুকুর, নারিশ পোল্ট্রি ফিডের ডিলার শিপ কেড়ে নেয়া সহ নানাভাবে সম্পদের মালিক তিনি।

২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তার স্বরুপ বেরিয়ে আসে। তার কথার অবাধ্য হলেই শুরু হয় নির্যাতন। তিনি তিনটা গাড়ি ব্যবহার করেন, যার দাম এক কোটি টাকা। গত ১৪ বছরে কিভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন সৈয়দ মুনতাজ আলী-সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। এমন পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যানের অবৈধ কর্মকা- ও ইউপি সদস্য নাহিদ শেখ কে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার বিচার দাবি করেন ভুক্তভোগী পরিবার ও ইউপি সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে আসা একাধিক নির্যাতিত ও হুমকি পাওয়া নারী পুরুষ বলেন, ৫ আগস্টের পর চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনতাজ আলীর আসর রুপ প্রকাশ পেয়েছে। টেবুনিয়া বাজারের সহ¯্রাধিক ব্যবসায়ীদের সমিতি দখল করে ইচ্ছেমতো ৫ সদস্যের আহবায়ক কমিটি করেছেন। তার আহবায়ক হলেন তিনি। টেবুনিয়া বাজার জামে মসজিদ থেকে ইমামকে সড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে দেয়া হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর এক প্রভাবশালী নেতাকে। টেবুনিয়া বাজার থেকে চোরপূর্বক অতিরিক্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদার টাকা চলে যাচ্ছে তার কাছে। সদরের মালিগাছা মজিদপুর মসজিদের কমিটি থেকে তার অপছন্দের লোকজনকে বের করে দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো লোক দেয়া হয়েছে। গোরস্থান কমিটি বাতিল করে তার ভাইকে দেয়া হয়েছে শীর্ষ পদ।

স্থানীয় ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউপি নির্বাচনে তিনি অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। রাতের আধারে বিকাশের মাধ্যমে ১০ হাজার ভোটারকে ১ হাজার করে টাকা দিয়েছে। সেই সাথে ভোটারদের দেয়া হয়েছে শাড়ি, লুঙ্গি ও থ্রিপিচ। দিয়েছেন ভোটারদের গুরু কেটে এক কেজি করে গোস। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কোন ট্যাক্স আদায় করবেন না। কিন্তু নির্বাচিত হয়েই বকেয়ার নামে ট্যাক্স তোলা অব্যাহত রেখেছেন।

তার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত ইউপি মেম্বাররা বলেন, ৯ জন ইউপি সদস্য থাকলেও তার পছন্দের ৪ জনকে কমপক্ষে ৩০/৪০ টি পিআইসি কমিটি দিয়েছেন। দিয়েছেন অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধাসহ প্রকল্প। কিন্তু ৫ জনকে করেছেন কোনঠাসা। ইউপির যে কোন মিটিং, উন্নয়ন প্রকল্প বা কর্মসূচী থাকলে তার তিনি তার গুন্ডা বাহিনী দিয়ে করে থাকেন। অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যান ৯ ইউপি সদস্যদের কোন কথা না শুনে নিজের ইচ্ছেতে প্যানেল চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। বিষয়টি ডিডি এলজিএসপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে অভিযোগ করা হলে তারা বসে চেয়ারম্যানকে সমঝোতা করার কথা বলায় ক্রমাগত তাদের উপর নেমে এসেছে জুলুম নির্যাতনসহ নানা হয়রানী। ইউপি সদস্যরা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্সের টাকায় আমাদের সম্মানী হয়। চেয়ারম্যান বকেয়ার নামে ট্যাক্স তুললেও আমাদের সম্মানী দেন না ৯ বছর। আমরা মানবেতন জীবন যাপন করছি।

অভিযোগ রয়েছে, পাবনা সদরের ১০ টি ইউনিয়নের টিসিবি পন্য কার্ডে বিতরণ চলমান থাকলেও সদ্য সমাপ্ত হওয়া উপজেলা নির্বাচনে তার পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে টিসিবি কার্ড বন্ধ করে দেন। উন্মুক্ত টিসিবি কার্ডের পণ্য তোলার জন্য তার পছন্দের মানুষের আইডি কার্ড নিয়ে বিতরণ করেন। সরকারের নানা সেবার বিতরণকৃত পণ্য গ্রাম পুলিশ বা ইউডিপ সদস্যদেরকে বিতরণে না রেখে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিতরণ করেন।

সংবাদ সম্মেলনে ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মাসুদ রানা, ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মুনছুর আলী, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনজারুল ইসলাম, আহত ৭ নং ওয়ার্ড সদস্য নাহিদ শেখের বোন রিনা খাতুনসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে গেল ২৮ আগস্ট চেয়ারম্যান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর দ্বারা হামলা ও মারপিটের শিকার হয়ে ইউপি সদস্য নাহিদ শেখের বাবা মোঃ জিন্নাত বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং জিআর ৫৪২, জিডি নং ৪৪। মামলায় চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনতাজ আলী, তার ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ আলীসহ ৮ জন নামীয়সহ ৪/৫ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত মালিগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনতাজ আলী মুঠোফোনে সাংবাদিকদের বলেন, ’আমার নামে মামলা হয়েছে জানি। তবে ইউপি সদস্যদের ওপর হামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। ওরা পরিষদ থেকে চলে যাওয়ার পরে রাস্তায় কে বলা কারা হামলা করেছে আমার জানা নেই। আর তারা আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছে তার কোনো ভিত্তি নেই।’

এ বিষয়ে পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন আলী বলেন, ’মালিগাছা ইউনিয়নের টেবুনিয়ায় ইউপি সদস্যদের উপর হামলার ঘটনায় আহত নাহিদের বাবা জিন্নাত শেখ বাদি হয়ে গত ২৯ আগস্ট সদর থানায় মামলা করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনতাজ আলীকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’