আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে আজ থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯। এ সম্মেলনে প্রায় ২০০টি দেশ অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যোগ দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার আজ বাকুতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ড. ইউনূস সম্মেলনে বাংলাদেশের জলবায়ু সংকট ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’, প্যারিস চুক্তির তহবিল ও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়টিও তুলে ধরবেন।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এবং এই সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর কাছে ন্যায়বিচার ও পর্যাপ্ত অর্থায়নের দাবি তুলতে যাচ্ছে। ড. ইউনূস বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষেও কথা বলবেন বলে জানা গেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল এ সম্মেলনে অংশ নেবে। তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্বল সম্প্রদায়গুলোর কাছে তহবিল পৌঁছাতে হবে।

বিগত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৩ অনুযায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো তহবিল দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও, প্যারিস চুক্তিতে এটি বাধ্যতামূলক না থাকায় উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রয়োজনীয় জলবায়ু অর্থায়ন পেতে ক্রমেই অসুবিধায় পড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) ২০১৫ সাল থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে মাত্র সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যা মাত্র ২-৩ শতাংশ। ২০২০-২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাত্র ৭১০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে।

বাংলাদেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এবারের সম্মেলন থেকে জলবায়ু অর্থায়নে সুস্পষ্ট অগ্রগতি ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া, বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হবে, যেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশ তাদের পরিকল্পনা উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের অর্ধেকই হবে বাংলাদেশ থেকে। কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির ফলে প্রায় ২ কোটি বাংলাদেশি অভিবাসী হতে পারে। ২০০৮-২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৪৭ লাখের বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, বিশেষত উপকূলীয় এলাকায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২০৮০ সালের মধ্যে উপকূলীয় ১৩ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাইরে নতুন বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল দাবি করছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য প্রয়োজন। এ কারণে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সহজলভ্য করা গুরুত্বপূর্ণ। কপ-২৯ সম্মেলনকে বাংলাদেশ এই অর্থায়নের জন্য দর-কষাকষির সুযোগ হিসেবে দেখছে। এদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জীবাশ্ম জ্বালানি লবির আধিপত্য রোধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত অর্থায়নের আহ্বান জানিয়েছে।

টিআইবি জানিয়েছে, কপ-২৯ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের বিবেচনার জন্য ৯ দফা সুপারিশ সংবলিত একটি পলিসি ব্রিফ জমা দেওয়া হয়েছে। তারা জলবায়ু অর্থায়নের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ-প্রক্রিয়ায় শুদ্ধাচার ও প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল সরবরাহে ঘাটতি, তহবিলের অপর্যাপ্ততা, ক্ষতিগ্রস্ত দেশে অভিযোজনে কম অগ্রাধিকারের পাশাপাশি প্রকল্প সময়াবদ্ধ বাস্তবায়ন ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে অনুদানভিত্তিক বরাদ্দ, এনডিসি বাস্তবায়ন জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় ঘাটতি চিহ্নিত করেছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কপ-২৯ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি লবির প্রভাব ও আয়োজক দেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে, ইউএনএফসিসিসি প্রতিবেদনে পছন্দসই পরিবর্তনে চাপ প্রয়োগসহ পরিবশেবান্ধব জ্বালানি প্রসারে অর্থ প্রদানের বিষয়ে প্রশ্ন তুলছে। অন্যদিকে, প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল প্রদান বাধ্যতামূলক না করে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে এবং ‘নতুন’ ও ‘অতিরিক্ত’ সহায়তাকে উন্নত দেশগুলো শর্তযুক্ত ঋণ আকারে প্রদান করছে।

তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল বাধ্যতামূলক না হওয়ায় এবং ৭০ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসেবে প্রদান করায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এবং তাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। ২০২৪ সাল থেকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করা হলেও তা কার্যত চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। তাই জীবাশ্ম জ্বালানি লবির প্রভাবমুক্ত, স্বার্থের দ্বন্দ্বহীন এবং বাস্তবসম্মত জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।