গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) পিকনিক বাস বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজন শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ বিভাগ, বিআরটিসি বাস কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায় রয়েছে বলে দাবী করেছে বুয়েটের স্বাধীন কমিটির তদন্ত দল। আইইউটি’র শিক্ষার্থী হতাহতের ঘটনায় সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন আইইউটি, বুয়েট এবং পল্লী বিদ্যুতের তিনটি তদন্ত কমিটি। তারা শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী এলাকায় সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘটনাস্থলে অবস্থান করে নানা তথ্য সংগ্রহ করেন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এদিন ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।

গত শনিবার (২৩ নভেম্বর) ওআইসি পরিচালিত গাজীপুর মহানগরের বোর্ড বাজারস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা পিকনিক করতে যাওয়ার পথে একটি বাস বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। এতে তিন শিক্ষার্থী নিহত ও কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে ৬টি তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। সোমবার আইইউটি, বুয়েট এবং পল্লী বিদ্যুতের তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী এলাকা পরিদর্শণ করেন। তারা নানা তথ্য সংগ্রহ করেন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। এ তিন কমিটির মধ্যে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি)তদন্ত দলের প্রধান প্রফেসর রাকিব হাসান, বাংলাদেশ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক জিয়াউর রহমান খান এবং ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর মহা-ব্যবস্থাপক (জিএম) আকমল হোসেন তদন্ত দলের নেতৃত্ব দেন। তবে তদন্ত দলের সদস্যরা উপস্থিত স্থানীয় সাংবাদিকের সাথে তদন্তের আগেই বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি।

দ্বিতল বাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় প্রাথমিকভাবে বুয়েটের স্বাধীন কমিটির তদন্ত দল বলছে বিদ্যুৎ বিভাগ, বিআরটিসি বাস কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায় রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক জিয়াউর রহমান খানের কাছে তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমরা জাস্ট দেখতে আসলাম এবং ঘটনাস্থলে এসে দেখলাম ভুলটা কোথায় ছিল। মাটির মায়া রিসোর্টের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) মাসুদ ইউসুফসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছি। এ বিষয়ে তদন্ত শেষ হওয়ার পর মন্তব্য করতে পারব।

বুয়েটের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি আমাদের নজরে আসার পর সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় আমরা কয়েকজন ঘটনাস্থলে এসেছি। সরেজমিনে গ্রামের সরু সড়ক বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঘুরে দেখেছি। দেখে যেটি মনে হলো গত কয়েক বছরে মাটির মায়া রিসোর্টের সড়কটি কমপক্ষে ৩ ফুট উঁচু হওয়াতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিচু হয়ে গেছে। সড়কের সাথে সাথে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উঁচু না হওয়ায় বিআরটিসির দ্বিতল বাসটির ছাদ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে লেগে যায়।

তিনি আরও বলেন, একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন অনেক স্থানে ঝুলে রয়েছে। আর যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে বিদ্যুৎ লাইন অনেকটাই ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা গেছে। গ্রামের এই সরু সড়ক দিয়ে কীভাবে দোতলা বাসে এতগুলো শিক্ষার্থীকে নেওয়া হচ্ছিল, এটিও একটি প্রশ্ন। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের উচ্চতা ১৬ ফুট। অপরদিকে সড়ক ৩ ফুট উঁচু হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিচু হয়েছে। তদন্ত শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করা হবে। এ মুহুর্তে আমি হুটহাট কোনো মন্তব্য না করলেও একটি কথা পরিষ্কার তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিআরটিসি বাস কর্তৃপক্ষ এবং রিসোর্ট কর্তৃপক্ষসহ সবার দায় রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শামীম আহমেদ জানান, ঘটনার দিন ডাবল ডেকারের তিনটা বাস এক সাথে দাঁড়িয়েছিল। এসময় সামনে থেকে একটি অটোরিক্সা আসছিল। তিনটি বাসের সর্ব পেছনের বাসের শিক্ষার্থী অথবা বাসের হেলপার (চালকের সহকারী) হাতে লাঠি নিয়ে অটোরিক্সার দিকে এগিয়ে যায়। ওই ব্যাক্তি লাঠি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় আমার আগ্রহ হলো কেনো ঝামেলা হয়েছে কি-না লাঠি নিয়ে যাচ্ছে কেন? পরে আমিও সামনের দিকে এগিয়ে দেখি সে অটোরিক্সার চালকের সাথে কথা বলতেছে। এক পর্যায়ে তর্কে জড়িয়ে উচ্চস্বরে বাক বিতন্ডা করছে। তখন পেছনের বাসের চালক হয়তোবা মনে কেরেছে অটোকে সাইড দিতে হবে, জায়গা সরু। পরে চালক বাসটি নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে বাসের পেছনের অংশ তারের সাথে লেগে যাওয়ার সাথে সাথে স্পার্ক শুরু হয় এবং বাসটি বিদ্যুতায়িত হয়। বিষয়টি বিদ্যুৎ অফিসকে মোবাইল ফোনে অবহিত করার সাথে সাথে তারা রেন্সপন্স করে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছন্ন করে।

এদিকে, পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা ঘটনার পরদিন রবিবার (২৪ নভেম্বর) দুর্ঘটনাস্থলে বিপদজনক এরিয়া হিসেবে লাল নিশান টানিয়ে দেয়। ৭টি লাঠিতে তারা সড়কের পাশে লাল কাপরের বড় বড় নিশান টানিয়ে দেওয়ায় স্থানীয়রা বলছেন এটি বিপদজনক এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গতঃ শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে ওআইসি পরিচালিত গাজীপুর মহানগরের বোর্ড বাজারস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রায় ৪৬০ জন শিক্ষার্থী বিআরটিসির ৬টি ডাবল ডেকার বাস তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে পিকনিক করতে শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টেও উদ্দেশ্যে রওনা হন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামীণ আঞ্চলিক সড়ক ধরে রিসোর্টের পথে যাওয়ার সময় সময় পেছনে থাকা একটি বাস স্থানীয় উদয়খালী বাজারে পৌঁছালে বাজার এলাকায় ঝুলে থাকা বিদ্যুতের ১১ কেভি তারের সঙ্গে স্পর্শ হয়। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই বাসের আরোহী তিন শিক্ষার্থী নিহত ও ৩ শিক্ষার্থী আহত হন।