দেশের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন ও চালকের হাতে নামমাত্র ফিতে লাইসেন্স প্রদান করা গেলে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে বলে দাবী করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
আজ সকালে নগরীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জরুরীভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ছোট যানবাহন চলাচল নীতিমালা প্রণয়নের দাবীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবী করেন।
তিনি বলেন, ২০১৬ সাল থেকে দেশে ইজিবাইকের বিস্তার লাভ করলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি এইখাত নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারী নানান ফোরামে প্রস্তাব তুলে ধরেন। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে সারাদেশে ৪০ লাখ অটোরিকশা থেকে দৈনিক ১১০ কোটি টাকা বছরে প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে চাদাঁবাজী হয়েছে। এই চাদাঁবাজীর কারনে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ দেশের সকল সড়ক-মহাসড়ক, নগর-বন্দরে মোটরচালিত অটোরিকশা দৌরাত্ব বেড়ে চরম আকার ধারন করেছে। পতিত আওয়ামী লীগের অনেক এমপি, মন্ত্রীও এই অবৈধ অটোরিকশা পরিচালনা করে অবৈধ চাদাঁবাজীতে যুক্ত ছিলেন, তাই এইখাতের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। অবাধে আমদানী, স্থানীয় গেরেজে সহজলভ্য ভাবে তৈরী করে সহজে রাস্তায় নামানোর অবাধে সুযোগ থাকায় এবং দেশে অন্যান্য খাতে সহজে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায়, স্বল্পপুঁজিতে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ অটোরিকশা কিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। এতে কৃষিখাতে শ্রমিক সংকটসহ কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। প্রশিক্ষণবিহিন লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের হাতে এসব অটোর স্টিয়ারিং এর কারনে সড়ক নিরাপত্তায় ভয়ানক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দেশের হাসপাতালগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তির চিত্র পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধির কারনে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রানহানী ভয়াবহভাবে বাড়ছে। বিগত ২০২৩ সালের ১ বছরে জাতীয় অর্থপেডিক (পঙ্গু হাসপাতাল) হাসপাতালে ১৪,৩৫৭ জন , চমেক হাসপাতালে ৯,৮৭৯ জন, কুমেক হাসপাতালে ৬,৭৪৮ জন, খুমেক হাসপাতালে ৯,২৯৩ জন, ঢামেক হাসপাতালে ৪,৭৮৪ জন, নারায়ণগঞ্জের খাঁনপুর হাসপাতালে ৪,৫৮৩ জন, পিজি হাসপাতালে ৩,৫৬৩ জনসহ এই ০৭ হাসপাতলে ৫৩,২০৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হয়েছে। এছাড়াও দেশে ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৭ জন হারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হচ্ছে। দেশে সরকার নিবন্ধিত ৪,০০০ বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ০৩ জন হারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হচ্ছে। সারাদেশের এমন ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র মোটরসাইকেলের বাণিজ্যিক ব্যবহার, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বেপরোয়া হারে বৃদ্ধির কারনে।
০৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পরে দেশের সড়ক থেকে ট্রাফিক পুলিশ উঠে গেলে এসব অটোরিকশা আরো বেপরোয়া হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল শুরু করে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট চরম আকার ধারন করায় নতুন সরকার এহেন ভয়াবহ যানজট কমাতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে মোটরচালিত অটোরিকশাসহ অযান্ত্রিক যানবাহন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। এহেন পরিস্থিতিতে গত ১৯ নভেম্বর মহামান্য হাইকোর্ট ০৩ দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধি নিষেধ আরোপ করার নির্দেশ দেন। এরই প্রেক্ষিতে সরকার রাজধানী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ করতে গেলে পুরো রাজধানীর লক্ষ লক্ষ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক ও মালিকেরা সংগঠিত হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক পথ, রেলপথে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। দেশের এক চরম অস্থির সময়ে নির্বাহী বিভাগের কাজে বিচার বিভাগ এগিয়ে আসা। মাত্র ০৩ দিনের মধ্যে রাজধানী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ বা নিয়ন্ত্রণের আদেশ দিয়েছেন আমরা এই আদেশ পুর্ণবিবেচনার মহামান্য হাইকোর্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, সরকার ২০২১ সালে “থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুুষ্টু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১” নামে একটি খসড়া নীতিমালা প্রনয়ণ করে। অথচ করোনা সংক্রমণে গণপরিবহন বন্ধ থাকার সুবাধে ২০২১-২০২২ সালে প্রায় ৮ লাখ হারে দুই বছরে ১৬ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ১০ লাখ হারে ২০ লাখ মোটরসাইকেল রাস্তায় নামে। সাথে সাথে সারাদেশে এইসব যানবাহনের কারনে সৃষ্ট যানজট ও দুর্ঘটনা দ্বিগুণ হলেও অদৃশ্য কারনে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি চূড়ান্ত করেনি। ভারত থেকে একচেটিয়াহারে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাহিন্দ্রা, অটো টেম্পু, হিউম্যান হলার আমদানি অব্যহত রাখার স্বার্থে তৎকালীন সরকার এই নীতিমালা থেকে সরে এসেছিলেন বলে তিনি অভিযোগ করে জরুরী ভিত্তিতে এই নীতিমালা প্রনয়ণের দাবী জানান।
তাই আজকের সংবাদ সম্মেলনে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধাণে নিম্মবর্ণিত সুপারিশমালা সমূহ-
১. জরুরীভিত্তিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রণীত “থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুুষ্টু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১” এর খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে।
২. বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার বডি মডিফাই করে ব্রেক ও গতির সমতা এনে সড়ক নিরাপত্তায় ঝুঁকিমুক্ত নিশ্চিত করে সার্টিফাইসহ নিবন্ধন নিতে হবে।
৩. সড়কের সক্ষমতা বিবেচনা করে সিলিং নির্ধারণ করতঃ দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে, বিআরটিএর নিয়ন্ত্রণে তাদের আওতাধীন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন প্রদান করতে হবে।
৪. প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চালককে নূন্যতম ১ সপ্তাহের সড়ক আইন-কানুন, ট্রাফিক চিহ্ন, সড়কে মোটর রিকশা চলাচল পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারীদের নামমাত্র ফি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। হুট করে গ্রাম থেকে এসে প্রশিক্ষণহীন কোন ব্যক্তি যাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. প্রতিটি ব্যাটরিচালিত রিকশায় ট্রাফিক বিভাগের সাথে সংযোগ স্থাপন করে জিপিএস লাগানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। জিপিএস ট্যাকিং এর মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীর প্রধান সড়ক, দেশের হাইওয়ে বা উপজেলা ও পৌরসভার প্রধান সড়কের যেটুকু অংশ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে সেই সড়কে প্রবেশ করা মাত্র জিপিএস এর মাধ্যমে ট্রাফিক বিভাগ অটো জরিমানা আদায় করতে পারবে এমন পন্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা জাতীয় মহাসড়কে চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. জরুরীভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে হবে।
৮. ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে প্রতিটি এলাকার নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতামত এবং যাত্রী সাধারনের সাথে গণশুনানী করে এলাকাভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, রিকশা-ব্যাটারিরিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন, চট্টগ্রাম ইলেক্ট্রিক থ্রি-হুইলার যানবাহন মালিক ও চালক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো: সিদ্দিক মিয়া, চট্টগ্রাম ইলেক্ট্রিক চার্জাররিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: সানাউল্লাহ চৌধুরী, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক, যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান প্রমুখ।