শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্রের সংস্কারে উদ্যোগী হয়। এরই মধ্যে পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কারে গঠন করা হয়েছে সংস্কার কমিশন। এসব কমিশনের নানামুখী উদ্যোগও শুরু হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, অন্যদিকে তখন দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপ বাড়ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। এ নিয়ে এক ধরনের স্নায়ুচাপ রয়েছে সরকারের ওপর; রাজনৈতিক দলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে নানা সন্দেহ-দ্বিধা।
বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর সময় যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানালেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে। পাশাপাশি জামায়াত, গণফোরাম, গণ-অধিকার পরিষদ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টও (এনডিএম) দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে একের পর এক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন মহলের ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সাময়িক হিসেবেই সবাই বিবেচনা করছে। নির্বাচন দিতে দেরি হলে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা বাড়বে এবং বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থনও কমে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তা নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোরও আগ্রহ রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক সরকারকে দায়িত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক আলোচনায় নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনা জানতে চেয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চলমান পরিস্থিতি, সংস্কার কার্যক্রম, উগ্রবাদের উত্থানের আশঙ্কা, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার একটি দেশ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তানসহ যেসব দেশের রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তাদের কণ্ঠেও ছিল অভিন্ন সুর।
দিন যত যাচ্ছে, নির্বাচনের দাবি ততই জোরালো হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের শীতলতা বেড়ে যায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা ও জাতীয় পতাকায় আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পারদর্শিতার ঘাটতি দেখছেন বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা। এতে করে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের দাবিও জোরালো হচ্ছে। সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কী প্রভাব পড়েছে, সে নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের ওপরও জোর দিচ্ছে।
যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসা বিএনপি এ বিষয়ে আর বেশি দিন ধৈর্য না ধরার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। দলটির তরফ থেকে এরই মধ্যে স্পষ্ট করেই নির্বাচনী রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ দেওয়া না হলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে সোচ্চার হবে দলটি। বিএনপি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দলটি বলেছে, সরকারের তরফে নির্বাচনের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। সরকারের কেউ কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, আমাদের এই সরকার খুবই স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী বছরই আমরা হয়তো একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব। জানি না কী হবে। আবার কেউ বলছেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তাই নির্বাচন নিয়ে সরকার কী ভাবছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা স্পষ্ট নয়।
বিএনপি বলেছে, সংস্কার একটি দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার যে ১০টি কমিশন করেছে, সেগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে কবে নাগাদ সংস্কার কার্যক্রম শেষ হবে, সেটাও স্পষ্ট নয়। অবশ্য বিএনপির তরফে এরই মধ্যে সরকারকে নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার কার্যক্রম চালানোর জন্য বলা হয়েছে। দলটির নেতারা বলেছেন, সব সংস্কার কার্যক্রম সমাপ্ত করতে গেলে এই সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে হবে। এটা সম্ভব নয়। এতে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে এবং নির্বাচন বিলম্বিত হবে। তাই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও আস্থা তৈরি হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন চাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার মন্তব্য করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল বলেন, ওই পর্যন্ত যেতে হলে সবাইকে ভূমিকা নিতে হবে। বিএনপি দেশে দ্রুত স্থিতিশীল অবস্থা দেখতে চায়। তিনি বলেন, আমরা দুই বছর আগে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ২৭ দফা দিয়েছিলাম। আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার বিদায় নিচ্ছে। তবে আমাদের জানা ছিল না, কবে স্বৈরাচারের বিদায় হবে। বর্তমানে ৩১ দফা অর্জন কম-বেশি তখনই করতে পারব, যখন জনগণের সমর্থন নিয়ে আপনারা সরকার গঠন করতে পারবেন। এ জন্য ৩১ দফাকে জনগণের দ্বারে দ্বারে নিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা জনগণের সিদ্ধান্ত মেনে নেব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলে ষড়যন্ত্র পাত্তা পাবে না। তিনি বলেন, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে জনগণকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। যদি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়, তাহলে জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। জনগণ নির্বাচনমুখী হলে আজকে যেসব ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেসব ষড়যন্ত্র পাত্তা পাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের কমিটমেন্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তবে সংস্কারের ঘোষণা দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সংস্কার করা। তিনি বলেন, কোনো একক সরকারের পক্ষে দিন তারিখ ঠিক করে সংস্কার করা সম্ভব নয়। আপনারা শুরু করুন, পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার তা এগিয়ে নেবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত হোক, তিনি তা চান না। এমনটি ঘটলে সরকার দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। দেশের মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। যুক্তিসঙ্গতভাবে বোঝা যাবে, আগে সংস্কার হবে, পরে নির্বাচন। তবে সংস্কার পর্যন্ত নির্বাচনের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার প্রয়োজন নেই। সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় লাগবে। সরকারের মেয়াদকাল দীর্ঘায়িত হলে জাতির জন্য কল্যাণ নেই। আবার সংক্ষিপ্ত হলে প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে না। জামায়াতের ৪১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের মাত্র ১০টি এই সরকারকে করতে বলেছি। বাকিগুলো নির্বাচিত সরকার করবে।