পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, নদীগুলোকে শিল্প বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিনত করার অধিকার কোন আইনে কোন শিল্পপতিকে দেয়া হয় নি। বিশ্বের কোন আইন কোন শিল্পপতিকে তার ব্যবসায়িক লাভের জন্য বর্জ্য শোধন না করে নদীতে ফেলার লাইসেন্স দেয়নি। আমরা অনেক ট্যানারি বানাতে পারবো, পয়ঃবর্জ্যরে জন্য বিকল্প করতে পারবো, কিন্তু নদী সৃষ্টি করতে পারবো না। যেহেতু নদী সৃষ্টি করতে পারবো না, তাই আমরা নদী ধ্বংস করবো না। নদীকে একটি সুন্দর প্রাণ ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে হবে। এটাই হচ্ছে যুব সমাজের প্রতি আমার আহবান।

তিনি বলেন, যে উন্নয়ন বাতাসকে দূষিত করে, নদী ও কৃষিকে মেরে ফেলে, মায়ের দুধে-রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশিয়ে দেয়- সেই উন্নয়ন আসলে উন্নয়ন নয়। এখন আমাদের দেশে সময় এসেছে উন্নয়নকে নতুন করে দেখার। আমরা বড় বড় শপিংমল-রাস্তাকে উন্নয়ন বলছি, আপনারা তা বলবেন না। আপনাদের উন্নয়নের সজ্ঞায় প্রবাহমান নদী থাকবে।

শনিবার তিনি গাজীপুর শহরের পিটিআই অডিটরিয়ামে আয়োজিত নদী বাঁচাতে যুব সম্মেলন ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, নদী দূষনের মধ্যে অনেক কারণের মধ্যে দু’টি বড় কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অপরিকল্পিত শিল্পের কারণে এবং অপরটি হচ্ছে স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও দেশে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠা। গাজীপুরের কথা কি বলবো- ঢাকায়ই এ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠে নি। এছাড়াও আরেকটি কারণ হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভাগুলোও তাদের বর্জ্য নদীতে ফেলে দূষণ করছে। এরসাথে যোগ হয়েছে প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ। কোন কোন নদীতে ৩ থেকে ৬ মিটার প্লাস্টিকের আস্তরণ আছে। আমরা নদীগুলো পরিষ্কার করি। কিন্তু প্লাস্টিক ও পলিথিনগুলো ড্রেজারে উঠে না, ড্রেজার আটকে যায়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের যতো মানুষ যাতায়ত করে, তার অর্ধেক যাতায়ত করে নদী পথে। এখনো মরে যাওয়া নদীগুলো আমাদের যাতায়তে বড় ভূমিকা রাখছে। বিশ্বে মাছ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ কখনো দ্বিতীয়, কখনো তৃতীয় আবার কখনো চতুর্থস্থানে। নদীর মাছ ও চাষের মাছের মধ্যে তফাৎ আছে এটা আমাদের বুঝতে হবে। তাই নদীগুলো রক্ষায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের কারণে জলবায়ুর মতো ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে তরুন প্রজন্ম। আগামী প্রজন্ম, যাদের জন্য আমরা গাড়ি-বাড়ি করি, টাকা জমাই, সেই আগামী প্রজন্ম ভয়ংকর সমস্যার সম্মুখীন হবে। পরিবেশের যে বিরূপ প্রভাব সেটির কবলে পড়বে। আগামী প্রজন্মকে যদি একটি দূষণমুক্ত নদী না দিতে পারি তাহলে ওরা পানি পাবে কোথায়, মাছ পাবে কোথায়? মাছ’ই যদি না পায় তাহলে ওরা মাছে ভাতে বাঙালি না হয়ে ফার্মের মুরগি আর ভাতে বাঙালি হবে!

তিনি আরো বলেন, তুরাগ দূষণের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দূষণকারীদের ম্যানেজমেন্ট ব্যবহারের মধ্যে আনা হবে। নদ নদীগুলো যাতে দূষণ না হয় সেইক্ষেত্র শিল্প প্রতিষ্ঠাণগুলোকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়ার আগে তা ভাল করে দেখে দেয়া হবে। সবকিছু দেখে যদি ছাড়পত্র দেয়া হতো বা রিভিউ করা হতো তাহলে নদীগুলোর আজকের এ অবস্থা হতো না।

উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, প্রকৃতির সাথে কখনো লড়াইয়ে যেতে নেই। প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে কেউ জিতেছে বা প্রকৃতি হেরেছে এমন ইতিহাসের কথা আমার জানা নেই। উন্নয়নকে নতুন প্রজন্ম হিসেবে নতুন করে দেখতে হবে। আমাদের বাতাস পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস। পৃথিবীর দূষিত ১০টি নদীর মধ্যে আমাদের নদী এক নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের পলিথিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যতো দেশের পলিথিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আছে নীচের দিক থেকে ১০টির মধ্যে ৯ নম্বরে।

তিনি গাজীপুরের লবনদহ নদী নিয়ে বলেন, লবনদহের দুইটি সমস্যা। একটি দখল ও অপরটি দূষণ। দখল উচ্ছেদে বসে থাকার কারণ নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমরা তা করবো। লবনদহকে কারা কারা দূষন করছে, সেই তালিকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছে আছে। তাদেরকে অনলাইন মনিটরিংয়ের আওতায় আনেন, নিয়মিত পানি পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে নদী বাঁচাতে দুই একটি শিল্প কারখানা বন্ধও করে দিব।

উপদেষ্টা বলেন, বন দখলকারীদের প্রতিরোধ করতে কীভাবে কাজ করতে হয় তা আমরা জানি। আগামী তিন মাসের মধ্যে দখল হওয়া জমি উদ্ধারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেশের প্রভাবশালীরা বন ও নদী দখল করছে। এ ক্ষেত্রে তারা সাইনবোর্ড হিসেবে গরীব মানুষদের সামনে রাখে। যাতে উচ্ছেদ করতে গেলে মনে হয় ভ’মিহীন। উচ্ছেদ করতে গেলে বাধা আসবেই। আমাদের তার পাল্টা ব্যবস্থা করতে হবে। অবৈধ দখলদাররা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বনভূমি ও পরিবেশ সুরক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বৃক্ষনিধন ও শিল্পকারখানার দূষণ বন্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপদেষ্টা বলেন, গত ৫ আগস্টের পরে গাজীপুরে অবৈধভাবে দখল হওয়া ৯০ একর বনভূমির মধ্যে ১৬ একর ইতোমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের জেলা প্রশাসকদের বনের সীমানা নির্ধারণের কাজ দ্রুত শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ৫৩ বছর হয়ে গেছে, বনের সীমানা নির্ধারণ কেন হয়নি? তাই বনের সীমানা নির্ধারণের নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। শিল্পকারখানার বিষয়ে আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। গাজীপুরে বনের ভেতর অনেক রিসোর্ট রয়েছে। প্রভাবশালীরা বনের জমি দখল অনেক এসব রিসোর্ট স্থাপন করে করেছে। এছাড়াও প্রতিটি জেলায় অন্ততঃ একটি করে নদীকে চিহ্নিত করে দখল ও দূষণ মুক্ত করার জন্য প্রত্যেকটা জেলা প্রশাসককে বলেছি। ইতোমধ্যে আমরা প্রতি জেলা থেকে ব্যয় সাশ্রয়ী কর্মপরিকল্পনা পেয়েছি। এখন আমরা কাজ শুরু করছি। ঢাকা বিভাগের তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর বিষয়েও কর্মপরিকল্পনা করবো।

পিটিআই অডিটরিয়ামের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। বক্তব্য রাখেন- বাপাউবো’র প্রধান প্রকৌশলী নাফিউস সাজ্জাদ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান, পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. সোহরাব আলী, গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন, জেলা পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক, রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, কাটার সেকশন ড্রেজার ওনার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বশির আহমেদ, বহুমুখী পাটকল উৎপাদন ও রপ্তানীকারক সমিতির সভাপতি রাশেদুল করিম মুন্না, ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার এসোসিয়েশন-বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন।

এরআগে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিনের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলার পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেকসহ আর্মি সিকিউরিটি ইউনিটের অধিনায়ক, ৬৩ বিজিবির অধিনায়ক, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সচিব, বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।