টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে লাখ লাখ ধর্মপ্রান মুসলমানের কন্ঠে আমিন আল্লাহুমা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রবিবার শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ। মোনাজাতে মহান আল্লার কাছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ্ ভিক্ষা করছিলেন মুসুল্লীরা। ক্ষমা লাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁরা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনা করা হয় তাবলিগ জামাতের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের আখেরী মোনাজাতে। এরআগে হেদায়েতী বয়ান করা হয়। ইজতেমায় আখেরী মোনাজাত চলাকালে পৃথক দুটি ড্রোন দুর্ঘটনায় আতংকিত হয়ে দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে গিয়ে প্রায় এক’শ জন মুসল্লী আহত হয়েছেন।
এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব দু’টি ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সোমবার হতে শুরু হচ্ছে এ পর্বের দ্বিতীয় ধাপ। বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের অনুসারী শুরায়ী নেজাম এর নেতৃত্বে এ পর্বটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দু’টি ভাগে বিভক্ত এ পর্বের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হচ্ছে সোমবার হতে। এ ধাপের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছেন শুরায়ী নেজামের মুসুল্লীরা। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তাবলীগ অনুসারীরা এ পর্বের ইজতেমায় অংশ নিবেন। তিনদিন ব্যাপী এ পর্বের ইজতেমা আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
মোনাজাত ॥
এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের শেষদিন রবিবার বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের তাবলীগ মারকাজের কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের ছোট ছোট বাক্যে আরবী-উর্দু ও বাংলা ভাষায় প্রায় ২৭ মিনিট ব্যাপী আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করেন। তিনি সকাল ৯টা ১০মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু করেন এবং তা চলে ৯টা ৩৭ মিনিট পর্যন্ত। পবিত্র কোরআনের আরবী আয়াত এবং বাংলা ও উর্দু ভাষায় প্রায় ২৭ মিনিট ব্যাপী মোনাজাত মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোনাজাত শুরু হতেই পুরো এলাকা জুড়ে নেমে আসে পিন পতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। খানিক পর পর শুধু ভেসে আসে আমিন, ছুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন। অনুতপ্ত মানুষের কান্নার আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তাঁরা। ক্ষমা লাভের আশায় ধনী-গরীব-শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষে সর্বস্তরের লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁরা ভোর থেকেই। বহু মানুষের অংশগ্রহণে ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে রবিবার। এবারের প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২৫-৩০ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে সংশি¬ষ্ট সূত্রের ধারণা। মুঠোফোন ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের আরও লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। অনেকে রাজধানীর বিমানবন্দর গোল চত্বর কিংবা উত্তরা এবং গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
মুসুল্লীদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার ॥
এদিকে, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার ভোর রাত থেকেই টঙ্গীর ইজতেমা অভিমুখে শুরু হয় বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষের ঢল। টঙ্গীর পথে শনিবার মধ্যরাত থেকেই ইজতেমা ময়দানগামী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোটর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মোনাজাতে অংশ নিতে শীত ও নানা ঝামেলা উপেক্ষা করে চারদিক থেকে লাখ লাখ মুসুল্লী পায়ে হেঁটেই ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন। মোনাজাতের আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ায় মুসুল্লীরা মাঠের আশে-পাশের রাস্তা,অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছুতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পাশ্ববর্তী বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসুল্লীরা অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পড়া মানুষ আর মানুষ। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৪-৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রবিবার আশে-পাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠান ছিল ছুটি। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার সকালেই টঙ্গীর ইজতেমা এলাকায় পৌঁছেন।
শেষ দিনে বয়ানকারী ॥
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান জানান, রবিবার বিশ্ব তাবলীগ জামাতের প্রথম পর্বের শেষদিন ফজরের নামাজের পর হতে হেদায়াতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান। তিনি তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে যারা তাবলীগের সফওে আল্লাহর রাস্তায় জামাতে বের হবেন সেইসব মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনা মূলক হেদায়তি বয়ান করেন। তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। এরপর আখেরী মোনাজাত পর্যন্ত নসীয়ত মূলক কথা বলেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তাঁর বক্তব্যের তরজমা করেন মাওলানা জুবায়ের। এসময় ইজতেমাস্থলে আগতরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেসব বয়ান শুনেন। তবে এদিন হেদায়েতী বয়ানের আগে আর কোন বয়ান হয় নি।
মোনাজাতে যা বলা হয় ॥
মাওলানা জুবায়ের মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ তুমি তো ক্ষমাশীল, তোমার কাছেই তো আমরা ক্ষমা চাইব। দ্বীনের ওপর আমাদের চলা সহজ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তৌফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। নবীওয়ালা জিন্দেগি আমাদের নসিব করো। হো আল্লাহ আমাদের ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেন। গোপন গুনাহ, প্রকাশ্য গুনাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। এ বিশাল ময়দানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যার হাতকে আপনার পছন্দ হয় তার উছিলায় আমাদের সবার মোনাজাত কবুল করে নেন। আমাদের জিন্দিগি গুনাহ মুক্ত হওয়ার তৌফিক দেন। দুুনিয়ার সব নর-নারীর জীবনের গুনাহ মাফ করে দেন। হে আল্লাহ ইমানের হাকিকতে তামাম নসিব করে দেন। হে আল্লাহ ঈমানী সিফাত আমাদের মধ্যে পয়দা করে দেন। হে আল্লাহ আমাদের ঈমানী জিন্দেগি নসিব করে দেন। হে আল্লাহ আমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করে দেন।
দুটি ড্রোন দুর্ঘটনা, মুসুল্লী আহত ॥
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরী মোনাজাত চলাকালে পৃথক দুটি ড্রোন দুর্ঘটনার শব্দ আতংকিত হয়ে মুসল্লীদের দিকবিদিক ছুটোছুটিতে পদদলিত হয়ে, ড্রেন ও রাস্তায় পড়ে প্রায় এক’শ জন মুসল্লী আহত হয়েছেন। মোনাজাত শেষ হওয়ার ১০/১২ মিনিট আগে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এ ঘটনা ঘটে।
মোনাজাতের সময় আকাশে উড়ার সময় একটি ড্রোন হঠাৎ ইজতেমা ময়দানের বিদেশি কামরার টিনের চালার উপর আছড়ে পড়ে। টিনের উপর আছড়ে পড়ায় বিকট শব্দ হলে আতংকিত হলে মোনাজাত ফেলে মুসুল্লীরা মাঠ ছেড়ে দিকবিদিক ছুটাছুটি করে দৌড়াতে থাকেন। এসময় অনেকেই বলতে থাকে সা’দ পন্থীরা হামলা চালিয়েছে সবাই পালাও। মুসল্লীদের এমন দৌড়াদৌড়ি ইজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে উত্তরে চেরাগআলী, দক্ষিণে টঙ্গী আবদুল্লাহপুর, পূবে টঙ্গী স্টেশন, পশ্চিমে কামারপাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি করতে গিয়ে অনেকে পদদলিত হন। এতে অর্ধশতাধিক মুসুল্লী আহত হন। মোনাজাতের পর ইজতেমার বয়ান মঞ্চ থেকে মুসল্লীদের আশ্বস্ত করে ঘোষণা করা হয় একটি ক্যামেরা ড্রোন ইজতেমা ময়দানের একটি টিনের ছাউনিতে আঁছড়ে পড়েছিল, এতে ভয় বা আতঙ্কের কোন কারণ নেই। আমরা সবাই খামোশ থাকি।
অপর ঘটনাটি ঘটে টঙ্গী হাসপাতালের সামনে। এ ড্রোনটি আকাশে উড়ার সময় হঠাৎ নীচে একটি দোকানের বেলুনের উপর আছড়ে পড়ে। ড্রোনটি গ্যাসের খেলনা বেলুনের উপড় আছড়ে পড়লে বিক্রেতার বেলুনগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এতে চতুর্দিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় মোনাজাতরত মুসল্লীরা আতংকিত হয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের জন্য দিকবিদিক ছুটাছুটি শুরু করেন। এতে প্রায় অর্ধশত মুসুল্লী আহত হন।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ছবি সংগ্রহের জন্য ক্যামেরা সম্বলিত ড্রোন দু’টি আকাশে উড়ছিল। এসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বা চার্জ শেষ হয়ে ড্রোনগুলোর একটি ইজতেমা ময়দানের টিনের ছাউনিতে এবং অপরটি টঙ্গী মেডিকেলের সামনের সড়কে গ্যাস বেলুন বিক্রেতার বেলুনের উপর আছড়ে পড়ে শব্দের সৃষ্টি হয়। হঠাৎ এ ঘটনা ঘটায় মুসুল্লীরা আতংকিত হয়ে দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
গরম পানিতে ঝলসে গেলেন ৪মুসল্লী ॥
বিশ্ব ইজতেমায় গরম পানিতে ঝলসে গুরুতর আহত হয়েছেন চারজন মুসুল্লী। রবিবার আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর ময়দান থেকে হুড়োহুড়ি করে বের হওয়ার সময় চা’য়ের কেটলীর গরম পানি পড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
আহত মুসল্লিরা হলেন- বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার অলিদা বাগান গ্রামের আমজাদ সরকারের ছেলে জুয়েল (২৫), নাটোরের ফজলুর রহমানের ছেলে সোহেল (৩০), ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার জাবেদ আলীর ছেলে ফজল হক (৩৪), জামালপুরের আব্বাস আলী সরকারের ছেলে মোজাফফর আলী সরকার (৪৪)। তাদেরকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ফরিদ হোসেন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আখেরি মোনাজাতের পর হুড়োহুড়ি করে মুসল্লিরা ময়দান থেকে বের হওয়ার সময় বের অসাবধানতাবশত ইজতেমার ৪ নং গেটের ভিতরে চা’য়ের কেটলির গরম পানি পড়ে যায়। এসময় পানি ছিটকে চার মুসুল্লী আহত হয়। তাদের মধ্যে মুসুল্লী জুয়েলের ডান পায়ে চা’য়ের কেটলি পড়ে হাঁটুর নিচের অংশ ঝলসে যায়। তাকে উদ্ধার করে টঙ্গীর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
টঙ্গী শহীদ আহসানের মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক শাকিল বিন সিরাজ জানান, গুরুতর আহত জুয়েলকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের বার্ন ইউনিটে রেফার্ড করা হয়েছে।
মোনাজাত শেষে বিষ্ময়কর মানব ও যানজট ॥
মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া লক্ষাধিক মানুষ ভীড় ঠেলে একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। এতে ইজতেমা ময়দান এলাকার কামারপাড়া রোডে সৃষ্টি হয় বিষ্ময়কর দীর্ঘ মানবজট। ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকা হতে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া লাখ লাখ মুসুল্লীর প্রচন্ড ভীড়ের কারনে ইজতেমা ময়দান এলাকার কামারপাড়া সড়কের দু’পাশের সংযোগ মোড়ে মানব ও যানজটের সৃষ্টি হয়। বিষ্ময়কর এ মানব জটে আটকা পড়ে মুসুল্লীদের ভীড়ের মাঝে দীর্ঘ সময় একইস্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মানব জট ছাড়াতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমসিম খেতে হয়। এসময় অনেকের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন মালামাল খোয়া যায় এবং কয়েকজন আহত হয়। পরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য সেখানে পৌছে দীর্ঘ সময় চেষ্টার পর মানবজট ছাড়াতে সামর্থ হন। মোনাজাত শেষে গণপরিবহন না পেয়ে অনেক মুসুল্লী ইজতেমা মাঠ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হেঁটে রওনা হন।
আরো ২ মুসুল্লীর মৃত্যু ॥
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান জানান, ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপে আগত আরো দুই মুসুল্লী শনিবার দিবাগত রাত হতে রবিবার আখেরী মোনাজাত শুরু আগে পর্যন্ত মারা গেছেন। তারা হলেন- হবিগঞ্জ জেলা সদরের রামনগর তেগরিয়া এলাকার মৃত দোস্ত মোহাম্মদের ছেলে রমিজ আলী (৬০) ও ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানা এলাকার হাজী আব্দুল গফুর (৭৫)। এনিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপে যোগ দিতে আসা ৫জন মুসল্লি হৃদরোগ, ঠান্ডা ও বার্ধক্য জনিত কারণে ইজতেমা ময়দানে মারা গেছেন।
টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ॥
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর ও টঙ্গীর সকল কারখানায় ছুটি ছিল। ফলে এবার এসব কারখানার শ্রমিকদের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে সমস্যা হয়নি।
টেলিভিশন-মুঠোফোন ও ওয়্যারলেস সেটে মোনাজাত ॥
ইজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। টঙ্গীর ইজতেমাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে গত কয়েকবারের মতো এবারও গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদের মাইকে আখেরী মোনাজাত সম্প্রচার করা হয়। এখানে কয়েক হাজার নারী পুরুষ ঈদগাহ মাঠে এবং পার্শ্ববর্তী সড়কে ও ভবন গুলোতে জড়ো হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। এছাড়াও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় টেলিভিশন, ওয়্যালেস সেট ও মুঠোফোনের মাধ্যমে মোনাজাত প্রচার করা হয়। এসব স্থানেও পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। আবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করার কারনে অনেকে বাসায় বসে মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। এছাড়াও দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকে ইজতেমাস্থলে অবস্থানকারীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেও মোনাজাতে শরীক হয়েছেন।
প্রথম পর্বে দু’সহস্রাধিক জামাত তৈরী ॥
বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানাগেছে, বিভিন্ন দেশে তাবলীগের কাজে বের হতে এবার এজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে দু’সহস্রাধিক জামাত তৈরী হয়েছে। এরমধ্যে দেশীয় জামাত হয়েছে প্রায় দু’হাজার এবং প্রায় ৮শ’ বিদেশী জামাত হয়েছে। এসব জামাতে কেউ কেউ এক চিল্লা, দু’চিল্লা, তিন চিল্লা, ছয় চিল্লা ও একবছরের চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামি ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
বিদেশী মুসুল্লী ॥
রবিবার দুপুর পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, চাঁদ, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্থান, খিরগিজস্থান, মালয়েশিয়া, মরক্কো, নেপাল, কেনিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্দান ও দুবাইসহ বিশ্বের ৭৬টি দেশের প্রায় ৩ হাজার ৫০ জন মুসল্লী অংশ নেন। তা’ছাড়া এপর্বে দেশের ৬৪টি জেলার কয়েক লাখ মূসল্লীরা ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন বলে ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান জানিয়েছেন।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ॥
আখেরী মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বিপুল সংখ্যক নারী। ইজতেমায় নারীদের অংশ নেওয়ার বিধান না থাকলেও এসব নারীদের অধিকাংশই আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেন। এছাড়াও ভোর থেকে নারীরা ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের মাঠ, ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ও আশপাশের খোলা ময়দানে অবস্থান নেন। তারা স্বস্ব অবস্থানে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নেন।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥