তাবলীগ জামাতের এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপ সোমবার শুরু হয়েছে। নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শুরায়ী নেজামের (জুবায়ের পন্থী) তাবলীগ অনুসারী ২৩ জেলার মুসল্লীগণ এতে অংশ নিচ্ছেন। আগামী বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা। প্রথম পর্বে দু’টি ধাপে ইজতেমায় অংশ নেন শুরায়ী নেজাম অনুসারিরা। এ পর্বের প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপেও মঙ্গলবার বাদ আসর অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে। প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষ হওয়ার পর ৮দিন বিরতি দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সা’দপন্থিদের তিনদিনের ইজতেমা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আগামি ১৬ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সা’দপন্থিদের আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা। এদিকে বিদেশি মেহমানদের ভোগান্তি এড়াতে ফরেন টেন্টেই (বিদেশী তাঁবু) সাধারণ ডাইরীর করার ব্যবস্থা নিয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ।
ইজতেমায় জোবায়ের অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা মোঃ হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, রবিবার আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের ইজতেমা শেষ করে শুরায়ে নেজামের তাবলীগের সাথীরা রাতের মধ্যেই ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় ধাপের সাথীরা স্রোতের মতো আসতে শুরু করেছেন। এরমধ্যেই তারা ময়দানে অবস্থান নিচ্ছেন। আশাকরছি এধাপেও রেকর্ডসংখ্যক মুসুল্লী আসবেন। এখানে বিদ্যুৎ, পানি, প্যান্ডেল তৈরি, গ্যাস সরবরাহ প্রতিটি কাজই আলাদা আলাদা গ্রুপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। মুসল্লীরা তাবলীগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শোনেন এবং ইসলামের দাওয়াতী কাজ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেওয়ার জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যান। বিদেশিরা ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থান নিচ্ছেন।
তিনি জানান, এ ধাপের প্রথম দিন সোমবার বাদ ফজর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এধাপেও উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লি¬র উদ্দেশে যথারীতি তাবলীগের ৬ উসূল অর্থাৎ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহীহ নিয়ত ও তাবলীগ ইত্যাদি বিষয়ে আমবয়ানের মাধ্যমে ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপের ৩দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। কোরান হাদিসের আলোকে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে তিনদিন ব্যাপী চলবে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের বয়ান
ইজতেমার বয়ানকারীগণ ও আনুষ্ঠানিকতা ॥
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বীরা জানান, সোমবার বাদ ফজর উর্দূতে চ’ড়ান্ত আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সকালে খিত্তার জিম্মাদার সাথীদের সাথে মুজাকারা (আলোচনা) করা হয়। সাথীরা ইজতেমার পুরোটা সময় কিভাবে পার করা হবে তার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয় এসময়। এরপর সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন নজমের সাথীদের সাথে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমেদ হোসাইন। তা চলে দুপুর পর্যন্ত। দুপুরে জোহরের নামাজের পর বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। তার বয়ানের অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। এরপর বাদ আছর বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল হক এবং বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা আহমদ লাট বয়ান করেন। ইজতেমাস্থলের বয়ান মঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দূতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তা তরজমা করা হচ্ছে। পরে তাবলিগ মারকাজের শূরা সদস্য ও বুর্জুগরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত স¤পর্কে ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন।
আয়োজকরা বলেছেন, বিশ্বইজতেমার কর্মসূচির মধ্যে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানোসহ নতুন জামাত এ ধাপেও তৈরি হবে।
স্বাস্থ্য সেবা ॥
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাববধায়ক জানান, এধাপেও মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্য বিভাগের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এ হাসপাতালে ইজতেমা উপলক্ষ্যে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠাণের উদ্যোগে মুসুল্লীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা দিতে এজতেমা ময়দান ও আশেপাশের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ওইসব ক্যাম্প থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের ন্যায় বিন্যামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
বিদেশী মুসল্লি ॥
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান জানান, সোমবার পর্যন্ত তাবলীগ অনুসারী ৭২ দেশের ৩হাজার ২২৫জন বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করছেন।
কন্ট্রোল রুম ॥
প্রথম ধাপের মতো এ ধাপেও বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা ও মুসল্লিদের খেদমতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের (ডেসকো) পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
বিদেশীদের ভোগান্তি এড়াতে তাঁবুতেই জিডি করার ব্যবস্থা ॥
এদিকে বিদেশি মেহমানদের ভোগান্তি এড়াতে পুলিশের পক্ষ থেকে ফরেন টেন্টেই (বিদেশী তাঁবু) সাধারণ ডাইরীর করার ব্যবস্থা নিয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-দক্ষিণ) এন এম নাসির উদ্দিন। টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান ও পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম বলেন, মুসল্লীদের পকেটমার ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৪ দিনে শতাধিক চোর ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ॥
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দ্বিতীয় ধাপের বিশ্ব ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আগের মতোই সকল প্রস্তুতি অব্যহত থাকবে। যেকোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আগের চাইতে আরো বেশি সজাগ ও সতর্ক থাকবে। ইজতেমার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন রয়েছে পুরো টঙ্গী ও আশেপাশের এলাকা জুড়ে। পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা, আইপি ক্যামেরা ও নাইটভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য বোম ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াট টিম, ডগ স্কোয়াড, বিস্ফোরক প্রশিক্ষক টিম, নৌবহর ও হেলিকপ্টার দিয়েও টহল দেয়া হচ্ছে ইজতেমা ময়দান এলাকায়। এছাড়া ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে, ইউনিফর্মে এবং মুসল্লী বেশে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা ইজতেমা ময়দান এলাকায় সার্বক্ষনিক কাজ করছেন।
তিনি আরো বলেন, রবিবার আখেরী মোনাজাত চলাকালে ড্রোন দুর্ঘটনায় বেশ কিছু মুসল্লী আহত হয়েছেন। ড্রোনগুলো পাবলিকের ছিল। এখন থেকে ইজতেমা ময়দানে ড্রোন উড়াতে গেলে পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিতে হবে। অন্য কোন সংস্থা যেন ইজতেমা ময়দানে ড্রোন উড়াতে না পারে সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
ইজতেমা ময়দানের পুলিশ কন্ট্রোলে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন আয়োজক কমিটির পক্ষে শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন জানান, পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মুসুল্লীদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও যাতায়তের জন্য সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পোশাকে ও সাদা পোশাকে ইজতেমা মাঠে মোতায়েন রয়েছেন। তিনি জানান, নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ খাবার ও আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধানের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হচ্ছে।
২০১৫ সাল হতে দু’পর্বে বিভক্ত বিশ্ব ইজতেমা ॥
ইজতেমার মুরুব্বীরা জানান, আগে বিশ্ব ইজতেমা একপর্বে অনুষ্ঠিত হতো। মতপার্থক্যের কারণে গত ২০১৫ সাল হতে দু’পর্বে বিভক্ত করে ইজতেমার আয়োজন করা হচ্ছে। এবারেও ইজতেমা দুই ভাগে (পর্ব) বিভক্ত হয়ে প্রথম পর্বের নেতৃত্বে রয়েছেন শুরায়ী নেজামের (জোবায়ের পন্থী) তাবলীগ অনুসারীগণ। প্রথমবারের মতো এ পর্বের ইজতেমা ছয় দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছে। এ পর্বটি আবার দু’টি ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ধাপে দেশের ৪২ জেলার মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করছেন। বাকি ২২ জেলার মুসল্লিরা দ্বিতীয় ধাপে নিচ্ছেন। প্রথমপর্বের ইজতেমার পর ৮দিন বিরতি দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সা’দপন্থিদের তিনদিনের ইজতেমা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি এ পর্বের আখেরি মোনাজাতের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের কাছে ইজতেমা মাঠ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
ইজতেমার মুরুব্বীদের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে এজতেমার আয়োজন শুরু করা হয়। তারপর ১৯৪৮সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮সালে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধরগঞ্জে এজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমানস্থলে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০একর জমি স্থায়ীভাবে এজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥