রাজশাহীর তানোরে ফতোয়া জারি করে এক গৃহবধূকে (২৭) ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় গ্রাম্য সালিশে ৭ বার কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে। এছাড়াও অভিযুক্ত বখাটে বেলাল উদ্দীনের(২৯) সাড়ে ৮ হাজার টাকা জরিমানা করে তাকেও কান ধরে উঠবস করানো হয়। ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার দিবাগত রাতে উপজেলার বিল্লি দিঘিপাড়া গ্রামে। এঘটনায় এলাকায় চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। ভিমটিম জানান, উপজেলার কলমা ইউনিয়ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি তাজিম উদ্দীন, ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা শরিফুল ইসলাম, গ্রাম্য মোড়ল বাবুল মিয়া, আবু সুফিয়ানসহ বেশ কয়েকজন গ্রাম্য মোড়লের নেতৃত্বে গত শনিবার রাতে তার বাড়ির পাশে সালিশ বৈঠক বসে। বৈঠকে তাকে ৭ বার কান ধরে উঠবস করানো হয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করায় তার শাস্তি হিসেবে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে জানান ভিকটিম।

এদিকে, ঘটনার পর থেকে ওই গৃহবধূ লোক লজ্জায় বাড়ির বাহিরে বের হতে পারছেন না। ভুক্তভোগীর দাবী, থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরেও সরকার দর্লীয় স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী গ্রামে এই সালিশ বসিয়ে জোর করে সমঝতার কাগজে সই করিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও সকলের সামনে তাকে ৭ বার কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে। ভিকটিমের পরিবার ও প্রতিবেশীরা জানায়, উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বিল্লি দিঘিপাড়া গ্রামের লিয়াকত আলীর বখাটে ছেলে বেলাল উদ্দীন পাশের বাড়ির এক দিনমজুরের স্ত্রীকে দীর্ঘদিন থেকে কু-প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। এতে ওই গৃহবধূ রাজি না হওয়ায় বখাটে বেলাল চলতি মাসের গত রোববার (১৬ এপ্রিল) রাত ১টার দিকে ওই গৃহবধূর বাড়িতে ঢুকে মুখ চেপে ধর্ষণ চেষ্টা চালায়। এসময় তার স্বামী কর্মের সন্ধানে কাজ করতে রাজধানী ঢাকায় ছিলেন।

এঅবস্থায় গৃহবধূর বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে। কৌশলে বেড়ার দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় বখাটে বেলাল। বিষয়টি নিয়ে রাতেই গ্রাম্য মোড়ল আবু সুফিয়ানকে জানানো হলে নিষ্পত্তি করার আশ্বাস দেন তিনি। তবে, এঘটনার দুইদিন অতিবাহিত হলেও কোন সুরাহা হয়নি। ফলে নিরুপাই হয়ে গৃহবধূ বুধবার সকালে তানোর থানায় বখাটে বেলালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের পর তানোর থানার এএসআই শাহজাহান সিরাজ গত শুক্রবার ঘটনাটি তদন্তের জন্য যান। এরপর টনক নড়ে বখাটে বেলাল ও গ্রাম্য মোড়লের। পরে শনিবার দিবাগত রাত ৮টার দিকে ইউপি সদস্য ও আ.লীগ নেতা শরিফুলের নেতৃত্বে ভিকটিমের বাড়ির পাশে সালিশ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে গৃহবধূকে জোর করে ৭ বার কান ধরে উঠবস করানোর মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়।

পাশাপাশি ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ স্বীকার করায় জরিমানা বাবদ অভিযুক্ত বেলালের কাছ থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা আদায় করা হয়। এছাড়া তাকেও সাতবার কান ধরে উঠবস করানো হয়। পরে ওই টাকা মোড়লরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে ভিকটিমকে রাতেই টাকা ফেরৎ দেয়া হয়। নারীঘটিত বিচার গ্রাম্য সালিশে করার এখতিয়ার আছে কি না এসম্পর্কে জানতে যাওয়া হলে গ্রাম্য মোড়ল আবু সুফিয়ান জানান, এরকম ঘটনা শালিসে বিচার করার এখতিয়ার নেই। তবে, বাদী-বিবাদী দুইজনের মাঝে আগে থেকেই পরকীয়া সর্ম্পকের ঘটনা ছিল। এমনটি জেনে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে গ্রামের সবাই মিলেই এ বিচার করা হয়েছে।

রোববার দুপুরে সরেজমিনে বিল্লি গ্রামে গৃহবধূর বাড়িতে গেলে তার শাশুড়ি জানান, মেম্বারদের কথায় তাদের ওপরই ভরসা রেখেছিলেন তারা। তবে তারা সঠিক বিচার করেন নি। আমরা এখন নিরুপায় হয়ে বসে আছি।
অভিযুক্ত যুবক বেলালের সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায় নি। তবে, তার বাবা লিয়াকত আলী বলেছেন বিষয়টি নিয়ে শনিবার দিবাগত রাতে মিমাংসা হয়ে গেছে। জরিমানার টাকা মোড়ল আবু সুফিয়ানকে দেয়া হয়েছে।

তানোর থানার এএসআই শাহজাহান সিরাজ জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি আমলে নিয়ে ঘটনাস্থল তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী গৃহবধূ স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মিমাংসায় বসে। গৃহবধূ চাইলে থানায় মামলা রুজু করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে তানোর থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) মির্জা আব্দুস সালাম জানান, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের কোনো ঘটনা গ্রাম্য সালিশে আপস করার বিধান নেই। ওই ঘটনা আমাকে কেউ জানায়নি। এখন খোঁজ-খবর নিয়ে এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মিজানুর রহমান, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি