মেহেরপুরে তালপাতার পাখা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা

‘তালের পাখা প্রানের সখা শীত কালে হয়না দেখা, গরম কালে হয় যে দেখা’ গ্রাম বাংলার এই প্রচলিত বাক্যটি বিদ্যুতের চরম লোডশেডিংয়ের কারণে যখন বৈদ্যুতিক পাখাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন মানুষের ক্লান্তি আর গরমের উষ্মতা মেটাতে তালের পাখা সখা হয়ে ঠান্ডা বাতাসে শরীর শীতল করে দেয়।

শরীর শীতল করা তাল পাতার পাখা তৈরিতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার কোলা গ্রামের পাখা পাড়ার পাখা কারিগররা। কোলা গ্রামের তালপাতার পাখা কারিগরের পাখার ঠান্ডা বাতাসে এখন শুধু মেহেরপুর জেলার মানুষের শরীর জুড়িয়েই দেয়না, আশেপাশের জেলাগুলোর মানুষের শরীরও জুড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, গ্রাম কোলা। কোলা গ্রামের পাখা পাড়ার নারী, পুরুষ, শিশু,বয়োবৃদ্ধরা যেন এক অপরের হাতে হাত লাগিয়ে সকলেই ব্যস্ত সময় পার করছেন পাখা তৈরিতে। কোমল হাতের ছোঁয়ায় তৈরি তালপাতার পাখাগুলোকে আরও আকর্ষনীয় করতে লাল, নীল, সবুজ রং দিয়ে বর্নিল সাজে সাজিয়েছে। তালপাতা ও পাখা তৈরির বাঁশের দু®প্রাপ্যতা এবং মূল্যবৃদ্ধির পরেও বংশপরম্পরা পাখা তৈরির মানুষগুলো এখন আর কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়না।

সরেজমিনে কোলা গ্রামের পাখা পাড়ায় গিয়ে পাখা তৈরির কারিগরদের সাথে কথা বলে এমনটাই মনে হয়েছে। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরপথের গ্রাম কোলা। গ্রামটি জেলার পুরাতন একটি গ্রাম। গ্রামে প্রায় ৫শ’ পরিবারের বসবাস। অধিকাংশ ঘরবাড়িই কাঁচা। আধাপাকা, পাকা কিছু ঘরবাড়ি ইদানিং তৈরি হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির লোকজনই অবসরে পাখা তৈরি কাজে সময় ব্যয় করেন। তবে পাখা পাড়ার মানুষগুলো সব সময়ই পাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন । পাখা পাড়ার মানুষের তৈরী পাখা কেউ ফেরি করে, কেউ হাটে বাজারে গিয়ে পাইকারি বিক্রি করে থাকেন। ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে তালগাছ ব্যবহারের কারণে এখন আর সহজে তালপাতা পাওয়া যায়না। বাঁশের দামও বেড়ে গেছে এমনটাই মন্তব্য করলেন পাখা কারিগররা। সেদিক থেকে তালপাতার পাখার দাম একটু কম হলেও, যা আয় হয় তাই দিয়েই তাদের জীবন যাপন করে, তাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চলে যায়।

পাখা কারিগর বয়োবৃদ্ধ রোজিনা বেগম জানান, বছরে আট মাস তারা তালপাখা তৈরি করে। আগে শ্রমিক দিয়ে তালপাখা বানানো হতো। এখন শ্রমিক দিয়ে পাখা তৈরি করলে, খরচ বেড়ে যায়। এজন্য বর্তমানে পরিবারের ছেলে-মেয়ে, গৃহবধূ মিলে পাখা তৈরি করেন। ফলে পাখার লাভ কম হলেও শ্রমের দামটা পাওয়া যায়। আগে একটি তালপাতা পাওয়া যেত ১২ থেকে ১৫ টাকায়, বাঁশ পাওয়া যেত একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকায়। এখন একটি তালপাতা কিনতে হয় ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। একটি বাঁশ কিনতে হয় দু’শ থেকে ২৫০ টাকায়। সে তুলনায় পাখার দাম বাড়েনি। আগে একটি পাখা বিক্রি হতো ৮ থেকে ১০ টাকায়। বর্তমানে প্রতিটি পাখা বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়।  পাখা পাড়ার রাকিব উদ্দিন জানান, বংশপরম্পরা তারা পাখা তৈরি করে আসছেন। বাড়ির ছেলে ও মেয়েরা অবসরে পাখা তৈরীতে সহযোগিতা করে বলেই ২৫ থেকে ৩০ টাকায় পাখা বিক্রি করে সংসারের সব আভাব-অভিযোগ দূর করা সম্ভব হয়।

গ্রামের সান্ত¡না খাতুন জানান, সারাদিনে তিনি ৪০-থেকে ৪৫টি পাখা তৈরি করতে পারেন। আগে সপ্তাহে একদিন তার স্বামী শহরে কিম্বা হাটে গিয়ে পাইকারি দরে পাখা বিক্রি করে আসতো। বর্তমানে পাখা ব্যবসায়িরা বাড়িতে এসে পাখা নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে পার্শবর্তী চুয়াডাঙ্গার লোকজন এসেও এখান থেকে পাখা কিনে নিয়ে য়ায়। যা লাভ হয়, তা দিয়েই তিনি সংসারে ছেলে-মেয়ের লেখা পড়ার খরচ জোগান দেন।  তিনি জানান, জুলাই ও আগস্ট মাসে তারা তালপাতা সংগ্রহ করে রাখেন। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তারা পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আবু আক্তার জানায়, স্কুল ছুটির পর সে বাবা-মাকে পাখা তৈরিতে সহযোগিতা করে। অন্য সময় নিজেদের অথবা অন্যের জমিতে শ্রম দেয়। একটি তালের পাতায় ৭ থেকে ৮ টি পাখা তৈরি করা যায়।