11 ময়মনসিংহের ত্রিশালে আজ রোববার প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরে টাঙ্গাইলের সখীপুরে গ্রেপ্তার হয়েছেন জেএমবির জঙ্গি রাকিব হাসান। রাকিব হাসানের পুরো নাম রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল। এই হাফেজ মাহমুদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ২০০৬ সালে র‌্যাব ধরে ফেলে জেএমবির শীর্ষ নেতা ফাঁসি কার্যকর হওয়া শায়খ আবদুর রহমানকে। জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান আত্মগোপন করেছিলেন সিলেট শহরের একটি বাড়িতে। তিনি এতই সতর্ক ছিলেন যে, কেউ তাঁকে খুঁজেই পাচ্ছিল না। একমাত্র হাফেজ মাহমুদ ধরা পড়ার পরই খুলে যায় সব জট। ৩৩ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর ২০০৬ সালের ২ মার্চ এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে আবদুর রহমানকে পাকড়াও করেন র‌্যাবের সদস্যরা। চাঞ্চল্যকর গোয়েন্দা কাহিনির মতোই হাফেজ মাহমুদ ও আবদুর রহমান গ্রেপ্তার অভিযানের পরতে পরতে ছিল চমকপ্রদ সব তথ্য। পুঙ্খানুপুঙ্খ এসব তথ্য পাওয়া যায় অভিযানের সময় খুব কাছে থেকে দেখে, র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে। অপারেশন ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ সকাল সাড়ে ১০টা। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে কেনাকাটা তখনো জমেনি। নিচের তলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন পাঠাগারে লোকজন কম। পাঠাগারের সিঁড়ি ও প্রবেশমুখে অচেনা হকার, টুপিবিক্রেতা, চশমার ফেরিওয়ালা। সবারই শিকারি চোখ। কার জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। আশপাশের দোকানিদের উৎসুক দৃষ্টি। ফিসফাস করে একজন জানতে চাইলেন, ‘ব্যাপার কী?’ অপেক্ষার জবাব মেলে। বেলা সাড়ে ১১টা। দাড়ি চাঁছা, রঙিন চশমা আঁটা, সবুজ শার্ট পরা এক ব্যক্তি আসেন পাঠাগারের গেটে। হেঁটে চলে যান গেট পর্যন্ত। পেছন থেকে একজন চেনার চেষ্টা করেন, আরেকজন নাম ধরে ডাকেন। আগন্তুক কোনো কথা না বলে হাত বাড়ান। হাত মেলান একজন। কিন্তু তিনি থামেন না। সোজা চলে যান ওপরে পাঠাগারের ভেতরে। কী মনে করে আবার বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ান। পাঠাগারের প্রথম টেবিলে বসে ছিলেন দুজন ক্যাপ্টেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কর্নেল গুলজার ও মেজর আতিক। আর অপেক্ষা নয়। কর্নেল সঙ্গীদের দিকে ইশারা করেন। শিকার হাতছাড়া হতে পারে। কোনো কথা নয়, একটি রিভলবার এসে ঠেকে যায় আগন্তুকের পিঠে। তাঁকে নিয়ে আসা হয় নিচে রাখা গাড়ির কাছে। এতক্ষণে তাঁর বুঝতে বাকি থাকে না এরা সবাই র‌্যাবের সদস্য। গোয়েন্দাগিরির খেলায় হেরে গেলেন জেএমবির মজলিসে শুরার সদস্য হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান। এক ফাঁকে পালানোরও চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেএমবির সামরিক প্রধান আতাউর রহমান সানি ধরা পড়ার পর র‌্যাবের পরবর্তী টার্গেট হন শায়খ আবদুর রহমান। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর কোনো হদিস মিলছিল না। সানিকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর র‌্যাব জানতে পারে, ঢাকার বনশ্রীর বাড়ি থেকে পালিয়ে শায়খ রহমান আশ্রয় নেন তাঁর পল্লবীর বাসায়। র‌্যাব সেখানে হানা দেওয়ার একটু আগেই তিনি চম্পট দেন। তবে সানির কাছ থেকে পাওয়া যায় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লু—হাফেজ মাহমুদ জানেন আবদুর রহমান সম্পর্কে অনেক তথ্য। ব্যস, শুরু হয়ে যায় হাফেজ মাহমুদকে পাকড়াও অভিযান। র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, অনেক কষ্টে তাঁরা জানতে পারেন, হাফেজ মাহমুদ নারকেল ব্যবসায়ী সেজে আছেন যশোরে। কর্মকর্তারা তাঁর ফোন নম্বর জোগাড় করেন। কিন্তু ফোনে কথা বলতে চান না হাফেজ। র‌্যাবের সোর্স অন্য পরিচয়ে নানা টোপ ফেলতে থাকেন। দীর্ঘ দুই মাস চলে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। একপর্যায়ে র‌্যাবের সোর্স বিদেশি এনজিওর লোক পরিচয় দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখান। বলা হয়, তাঁদের এসব কর্মকাণ্ডের পিছে একটি এনজিও অর্থ সাহায্য দিতে চায়। এবার বরফ গলে। টোপ গেলেন হাফেজ মাহমুদ। হাফেজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পর থেকেই তাঁর মুঠোফোনে তীক্ষ নজর রাখা হয়। দেখা যায়, র‌্যাবের সোর্সের সঙ্গে কথা বলার পরপরই হাফেজ মাহমুদ অন্য একটি নম্বরে ফোন করেন। কিন্তু তাঁদের কথা হয় সাংকেতিক ভাষায়। কিছুই বোঝা যায় না। একেক সময় ওই ব্যক্তির অবস্থান থাকে একেক জায়গায়। তবে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়, ওই ব্যক্তিই শায়খ রহমান। কিন্তু তার আগে ধরা দরকার হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসানকে। র‌্যাব সোর্সের টোপ গিলে হাফেজ রাজি হন, ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাঠাগারে আলোচনায় বসা হবে। র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল গুলজার ফাঁদ পাতেন ওই পাঠাগার ও তার আশপাশে। ওই দিন ভোর বেলা হাফেজ মাহমুদ যশোর থেকে নৈশকোচে ঢাকায় এসে নামেন, সে খবরও পায় র‌্যাব। ব্যস, শুরু হয় গোয়েন্দাগিরির খেলা। বায়তুল মোকাররম থেকে গ্রেপ্তার করা হাফেজ মাহমুদকে নিয়ে তখনই শুরু হয় প্রবল জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু হাফেজ অটল। শায়খ রহমানের অবস্থান তিনি কিছুতেই জানাবেন না। একপর্যায়ে শায়খের ফোন নম্বর জানাতে রাজি হন তিনি। তাঁর হাত থেকে মোবাইল সেট কেড়ে নিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা দেখেন, একটি নম্বরে বারবার কথা বলা হয়েছে। র‌্যাবের আইটি শাখার মেজর জোহা খোঁজ করে দেখেন এই নম্বরটি সিলেটের এমসি কলেজ টাওয়ার থেকে আসছে এবং টাওয়ারের ৮ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই ফোনটির অবস্থান। র‌্যাব মহাপরিচালক আবদুল আজিজ সরকারকে বিষয়টি জানানোর পর সিলেটে র‌্যাব-৯-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোমিনকে নির্দেশ দেন, টাওয়ার থেকে ৮ বর্গকিলোমিটার দ্রুত ঘেরাও করে ফেলতে। কর্নেল মোমিন, মেজর শিব্বির ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হায়দার তখনই পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেন। ঢাকা থেকেও রওনা হয় র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিনের নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের একটি দল।ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিকেল চারটার দিকে তাঁরা ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে সিলেট পৌঁছান রাত আটটায়।ওই দলে আরও ছিলেন মেজর আতিক, মেজর মানিক, মেজর জাভেদ, মেজর ওয়াসি, ক্যাপ্টেন তানভির ও ক্যাপ্টেন তোফাজ্জল।এঁরা পৌঁছানোর আগেই সিলেট র‌্যাবের প্রায় আড়াই শ সদস্য নগরের টিলাগড় ও শিবগঞ্জের আট বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রতিটি সড়ক ও গলিতে অবস্থান নেন।এঁদের সঙ্গে ঢাকার বাহিনী যোগ দিয়ে রাত ১০টা থেকে শুরু হয় চিরুনি অভিযান।আস্তে আস্তে পরিধি কমিয়ে এনে টিলাগড়, শাপলাবাগ, কল্যাণপুর, কালাশিল ও বাজপাড়া এলাকার প্রত্যেক বাড়িতে শুরু হয় তল্লাশি। তল্লাশির সময় র‌্যাবের হাতে থাকে শায়খ রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ছবিসংবলিত লিফলেট।রাত ১২টার দিকে সিলেট নগর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে টুলটিকর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব শাপলাবাগ আবাসিক এলাকায় আবদুস সালাম সড়কের ২২ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে প্রথম বাধা পায় র‌্যাব।এক ব্যক্তি ছুরি হাতে তেড়ে এসে বলে, এগোলে খারাপ হবে।এরপর যা বোঝার বুঝে ফেলে র‌্যাব।গোটা অভিযান তখন কেন্দ্রীভূত হয় এই বাড়ি ঘিরে।এই বাড়ির নাম ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’। র‌্যাব সদস্যরা দ্রুত ঘিরে ফেলেন সূর্যদীঘল বাড়ী।আশপাশের বাড়িতেও অবস্থান নেন অনেকে।নিয়ে আসা হয় ভারী অস্ত্র ও লাইফ সাপোর্ট জ্যাকেট।রাত পৌনে একটার দিকে মাইকে সূর্যদীঘল বাড়ীর লোকজনকে বেরিয়ে আসতে বললেও কেউ সাড়া দেয় না।তাদের নীরবতায় রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।আশপাশের বাড়ির লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়।রাত দেড়টার দিকে সূর্যদীঘল বাড়ির মালিক লন্ডনপ্রবাসী আবদুল হকের ছোট ভাই মইনুল হককে বাইরে থেকে ডেকে আনা হয়।তিনি মুখে মাইক লাগিয়ে বাড়ির ভাড়াটিয়া হূদয়ের নাম ধরে ডেকে দরজা খুলতে বলেন।তাতেও কাজ না হলে স্থানীয় ইউপি সদস্য নূরুন নবীকে দিয়ে আহ্বান জানানো হয়।কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। রাত দুইটার দিকে একবার বাড়ির পেছনে দরজা খোলার শব্দ হয়।র‌্যাব সদস্যরা সচকিত হয়ে ওঠেন।সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধও হয়ে যায়।রাত দুইটা ১০ মিনিটে হঠাৎ করে বাড়ির ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মানুষ ভারী গলায় দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করেন।কর্নেল গুলজার তখন আবদুর রহমানের নাম ধরে ডাক দিলে ভেতর থেকে ভারী গলার আওয়াজ আসে—‘ওই কাফের! তোর মুখে আমার নাম মানায় না, আমাকে মুজাহিদ বল।’ তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, এটাই শায়খ আবদুর রহমানের কণ্ঠ।এভাবে শেষ হয় প্রথম রাত।বুধবার সকাল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় দফার চেষ্টা।এর পরের কাহিনি সবার জানা। তবে কাহিনির ভেতরেও থাকে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা।র‌্যাব ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সারা রাত ধরে চেষ্টা চালিয়ে, একাধিকবার দীর্ঘ কথোপকথন চালিয়েও শায়খ রহমানকে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে পারছিলেন না।ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে।বুধবার সকাল ৯টা ৭ মিনিটে বাড়ির ভেতরে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।পর পর চার-পাঁচটা বিস্ফোরণ ঘটে।দ্রুত নিয়ে আসা হয় দালান ভাঙার যন্ত্রপাতি।সাড়ে ৯টার দিকে ভাঙা হয় দক্ষিণের একটি জানালা।বৈদ্যুতিক কাটার এনে ফুটো করা হয় ছাদ।প্রথমে আয়না লাগিয়ে, পরে রশি দিয়ে ক্যামেরা নামিয়ে দেখা হয়, ভেতরে কী আছে।দেখা যায়, একটা বিছানা থেকে তার বেরিয়ে আছে।শুরু হয় হইচই—নিশ্চয় সারা বাড়িতে বোমা পাতা আছে।বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা নিয়ে আসেন বড় বড় বড়শি।ফুটো দিয়ে নামিয়ে বিছানা টেনে তুলে দেখেন, সব ভুয়া—সাজানো আতঙ্ক। দুপুরের দিকে র‌্যাবের কাঁদানে গ্যাসে টিকতে না পেরে বেরিয়ে আসেন শায়খের স্ত্রী-ছেলে-মেয়েরা।সিলেটের জেলা প্রশাসক এম ফয়সল আলম শায়খের স্ত্রী রূপাকে বলেন, ‘আপনি আপনার স্বামীকে বেরিয়ে আসতে বলুন।’ রূপা বলেন, ‘আমার কথা শুনবেন না।উনি কারও কথা শোনেন না।’ জেলা প্রশাসক পীড়াপীড়ি করলে শায়খের স্ত্রী মাইকে বলেন, ‘উনারা বের হতে বলছে, আপনি বের হয়ে আসেন।’ স্ত্রীর কথায়ও কান দেন না শায়খ। বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট জেলা প্রশাসকের চূড়ান্ত হুমকির সুরে কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানালে অবশেষে জানালায় এসে উঁকি দেন শায়খ রহমান।এর পরের ঘটনাও সবার জানা। শায়খকে নিয়ে বসানো হলো সিলেটে র‌্যাবের কার্যালয়ে।শায়খের স্ত্রীকে জানানো হলো, আপনার স্বামী বের হয়ে এসেছেন।স্ত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘উনি না শহীদ হতে চেয়েছিলেন! কই হলেন না যে!!’