12দৈনিক বার্তাঃ সব মিলিয়ে সামনে দু’টি বড় চ্যালেঞ্জ ভারতের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের। প্রথমত, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। সার্ক নেতাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে সে দায়িত্ব এর মধ্যেই তাকে দিয়ে ফেলেছেন মোদি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সঙ্গে কংগ্রেসকালীন একপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয় বিবেচনা- সব আম এক ঝুড়িতে রাখার কংগ্রেসি নীতি অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে সব আম একাধিক ঝুড়িতে রাখার দিকে এগোবেন কি এগোবেন না- সেই বিবেচনা। এ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন। সে নির্বাচনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কংগ্রেসি ভারত হতাশ করে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষকে। সে হতাশা থেকে ভারত বিরোধিতার সুর ধরা পড়ে বিভিন্ন বক্তব্যে ও কর্মসূচিতে। তবে মোদির বিজয়ে বদলে গেছে পরিস্থিতি। ভারত বিরোধিতা এখন শূন্যের কোঠায়। সুষমা স্বরাজ এ পরিস্থিতির মূল্যায়ন অবশ্যই করবেন। ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রীর ভারত সফরকালে তিনিই ছিলেন স্বাগতিক।
১৮ বছর বয়সে রাজনীতির হাতেখড়ি। ২৫ বছর বয়সে রাজ্যসভার মন্ত্রী। ৩৭ বছর ধরে সমান তালে দল ও সরকারে অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে সামাল দিয়ে চলছেন সুষমা স্বরাজ। তার ওপর এবার বিদেশ মন্ত্রকের ভার ছেড়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত তথা মোদি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবেন পোড় খাওয়া ওই নারী রাজনীতিক। বিজেপির ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের মসনদে আসীন হওয়া নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক গড়তে চান তার টুইটার ডিপ্লোমেসিতে এর একটি খণ্ডচিত্র মিলেছে। আর প্রতিবেশী নীতি? সে তো শুরুর আগেই বাজিমাত হওয়ার মতো অবস্থা। মোদি হয়তো জানতেন ঘরে বাইরে সমালোচনা হবে, কাশ্মীরে সেদিনই তো ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে তার মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছে পাকিস্তানের সেনারা। দু’দেশের সম্পর্কের আলোচনায় ‘সেই লোমহর্ষক ঘটনাটি’ উদাহরণ হয়ে আসবে বার বার। কিন্তু মোদি তা পেছনে রেখেছেন। নতুন চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সহ সার্ক নেতাদের তার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কেবল আমন্ত্রণই নয়, যারা তার ডাকে সাড়া দেবেন সেই নেতাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে বৈঠকের জন্য সময়ও রেখেছেন তিনি। দীর্ঘ সময় সমালোচনার মুখে থাকা ওই নেতা এ দায়িত্ব গ্রহণের আগেই যে ভূমিকা রেখেছেন তার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া তথা পুরো বিশ্বেই একটি ইতিবাচক বার্তা গেছে। আগামীর দিনগুলোতে তার ওই ইতিবাচক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন বিজেপি রাজনীতির পরীক্ষিত নেত্রী সুষমা স্বরাজ। কঠিন এ দায়িত্ব তিনি কিভাবে সামাল দেবেন? শপথ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিকে ঘিরে যখন দিল্লির রাজনীতিতে নেতিবাচক আলোচনা তখন বিজেপি নেতারা এটাকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিবেচনায় না দেখার অনুরোধ জানিয়ে সমালোচকদের ক্ষান্ত করার চেষ্টা করেছেন। সেই সান্ত্বনা গতকাল পর্যন্ত হয়তো প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু আজ থেকে শুরু হবে নতুন আলোচনা। দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় যত মাধ্যম রয়েছে সব মিলেই একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা হয়। এ তো গেল পাকিস্তান! বাংলাদেশের সঙ্গে কি হবে? জাপান সফরের কারণে আমন্ত্রণ সত্ত্বেও শপথ অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বদলে স্পিকার- এ তো উপযুক্ত প্রতিনিধি। কিন্তু রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে যা ক্ষতি হওয়ার সব হয়ে গেছে। শিরিন শারমিনের মেধা যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না। উঠছে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে। তাছাড়া দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কংগ্রেসের সঙ্গেই বেশি সখ্য। বিজেপির সঙ্গে বৈরিতা না হলেও ভাব নেই। বিশ্ব সমপ্রদায় যখন বাংলাদেশে সব দলের অংশ গ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখার জন্য উন্মুখ হয়েছিল, জাতিসংঘ দূতিয়ালি করেছিল, তখন একমাত্র কংগ্রেসের সমর্থনকে পুঁজি করে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জোটকে বাদ দিয়ে ৫ই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে ফেলে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের অল্প ক’দিন আগে ভারতের শীর্ষ কূটনীতিক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং আচমকা ঢাকা সফর করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে যেতে জাতীয় পার্টিকেও পারামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা সেদিন অবাক হয়ে দেখেছিলেন একটি দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতের নেতৃত্ব কি তৎপর! আওয়ামী লীগের মিত্র কংগ্রেসকে শোচনীয় ভাবে পরাস্ত করে বিজয়ী হয়েছেন মোদি-সুষমারা। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে দীর্ঘ সময় ধরে চলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ওই পরিবর্তন এসেছে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে। যে দেশের চারদিকে ওই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, সেই প্রতিবেশীর নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের মানুষ। যদিও দিল্লি তথা কংগ্রেসের আওয়ামী লীগ প্রীতির কারণে এখানে ভারত বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে নানা ক্ষেত্রে। তবে সামপ্রতিক সময়ে অবস্থা ঠিক উল্টো। মোদি-সুষমারা বাংলাদেশ নিয়ে কি ভাবছেন? এখানে তো গণতন্ত্র মানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী, স্পিকার-সবই তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়! এখানে একটি নতুন নির্বাচনের আওয়াজ- উঠেছে নির্বাচনের পর দিন থেকে। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের তরফে বিশ্ব সমপ্রদায়কে বোঝানো হয়েছিল- একটি নির্বাচন হয়ে যাক, তারপর আলোচনা বা সংলাপ করে দ্রুত আরেকটি নির্বাচন করা যায় কিনা সেটা ভাববে সরকার। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়েছিলেন বিদেশী বন্ধুরা। কিন্তু কি হলো? বিদেশী চাপ দিনে দিনে বাড়ছে। ক্ষমতাসীনরা এখন নানা কথা বলছেন। শর্ত দিচ্ছেন। তারা সময় ক্ষেপণ করছেন। অবশ্য দেশের মানুষের চোখ ছিল দিল্লির দিকে। এখনও আছে। মোদি-সুষমারা সরকার গঠন করে ফেলেছেন। আজ থেকে হয়তো তাদের বিবেচনায়ও বিষয়টি নতুন করে আসবে। বাংলাদেশের মানুষ কি চাইছে এটি তারাও বোঝেন। সুষমা ও তার টিম হয়তো এ ক’দিনে আরও ভালভাবে জানার চেষ্টা করবেন। কেবল বাংলাদেশ বা পাকিস্তান নয়, আশপাশ, কাছে দূরের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়গুলোও বোঝার চেষ্টা করবেন। হিসাব মিলানোর কাজটি কঠিন। কিন্তু সুষমার জন্য এটি হয়তো এত কঠিন হবে না। তিনি বাংলাদেশকে বোঝেন। গত সংসদে তিনি বিরোধী নেতার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় নানা মাধ্যমের রাজনীতিক তথা জনমানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিস্ত্তা ও টিপাইমুখের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে তার সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃত্বের কথা হয়েছিল। এবার তিনি চালকের আসনে। দেখা যাক কি করেন। কংগ্রেসের মতো এক ঝুড়িতে সব আম রাখবেন নাকি দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে বাস্তবে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চেষ্টা চালাবেন। বাংলাদেশের মানুষ সেটিই দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।
অনেক ‘প্রথমের’ অধিকারী সুষমা: সদ্য সমাপ্ত পঞ্চদশ লোকসভায় (২০০৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর থেকে চলতি ১৮ই মে পর্যন্ত) বিরোধী নেতার দায়িত্বে ছিলেন সুষমা স্বরাজ। ৮ দিনের মাথায় গতকাল সন্ধ্যায় নবগঠিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। দেশটির প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলেন সুষমা। বিজেপির হয়ে এমনিতেই অনেক ‘প্রথমের’ অধিকারী তিনি। প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী, দলের প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক এবং পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন তিনি। ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে মধ্য প্রদেশের বিদিশা থেকে বিজেপি’র পদ্মফুল নিয়ে জয়ী হন ওই নেত্রী। বিদায়ী মনমোহন সিংয়ের সরকারে ১০ বছরে পি চিদাম্বরম, এস এম কৃষ্ণা ও সালমান খুরশিদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে হরিয়ানার মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জাতীয় রাজনীতিতে স্থান করে নিয়ে এর আগেও কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন সুষমা স্বরাজ। অটল বিহারি বাজপেয়ীর সরকারে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। হরিয়ানা সরকারের শিক্ষা এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাতবারের এই পার্লামেন্টারিয়ান। ভারতের পার্লামেন্টের প্রথম এবং একমাত্র নারী হিসেবে সেরা পার্লামেন্টারিয়ানের পুরস্কারও রয়েছে সুষমার ঝুলিতে। চারটি রাজ্য থেকে সরাসরি ১০টি নির্বাচনে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। ১৯৭০ সালে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের মাধ্যমে রাজনীতিতে নাম লেখান সুষমা। পরে আসেন জনতা পার্টিতে। ১৯৭৭ সালে জনতা পাটির নেতৃত্বে হরিয়ানা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন। এর দুই বছর পরই জনতা পাটির হরিয়ানা রাজ্যের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে হন একাদশ লোকসভার সদস্য। ওই বছর তিনি বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন ১৬ দিন বয়সী সরকারের তথ্য ও সমপ্রচারমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে লোকসভার অধিবেশন সরাসরি টেলিভিশনে সমপ্রচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে আবার একই মন্ত্রলায়ের দায়িত্ব পান তিনি। ওই বছরই দিল্লির প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ত্যাগ করেন সুষমা। সুষমা স্বরাজ্যের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বিপক্ষে নির্বাচন করা। ১৯৯৯ সালে কর্নাটকের বেলারি আসনে তাকে সোনিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করায় বিজেপি। মাত্র ১২ দিনের প্রচারে তিনি সাড়ে তিন লাখের বেশি ভোট টানতে পারলেও রাজীব গান্ধীর স্ত্রীর কাছে হারতে হয়েছিল সুষমাকে। ২০০০ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে ভারতের পার্লামেন্টে ফেরার পর ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালের মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে আবার মধ্যপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় বিজেপির উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ওই বছরই বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির উত্তরসূরি হিসেবে লোকসভায় বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পান।