বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী

দৈনিকবার্তা-ঢাকা,১৩ মার্চ: প্রাচীন বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ বাংলাদেশেরই নৃত্য। বিশ্বের সংস্কৃতি অঙ্গনে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিকে তুলে ধরার লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী’র সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের ব্যবস্থাপনায় ১২, ১৩, ১৪ মার্চ ২০১৫ এই তিনদিনব্যাপী ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ কর্মশালা’র আয়োজন করা হয়েছে। কর্মশালা পরিচালনা করছেন র‌্যাচেল প্রিয়াঙ্কা প্যারিস। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃত্য সংগঠনের ৪০জন নৃত্যশিল্পী অংশগ্রহণ করেছে।

কর্মশালার সমাপনী উপলক্ষ্যে আগামীকাল ১৪ মার্চ ২০১৫ বিকেল ৪টায় একাডেমীর জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের ৫নং মহড়া কক্ষে অংশগ্রহণকারী সকল প্রশিক্ষণার্থীদের সনদপত্র বিতরণ ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক জনাব লিয়াকত আলী লাকী এর সভাপতিত্বে উপস্থিত থাকবেন নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দোপাধ্যায়, শামীম আরা নীপা, কর্মশালার প্রশিক্ষক র‌্যাচেল প্রিয়াঙ্কা প্যারিস এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক জনাব সোহরাব উদ্দীন।

প্রসঙ্গত, বহুদিন থেকে আমাদের একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে আমাদের অর্থাৎ বাংলার কোন শাস্ত্রীয় নৃত্য নেই। বাঙালি একটি ঐতিহ্যশালী জাতি হবার পরও এদের কোন শাস্ত্রীয় নৃত্য নেই। সেই দিক বিবেচনায় বলা যায় যে ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ প্রাচীন বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য। ‘শাস্ত্রীয় নৃত্য’ নামকরণটি করেছেন অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও অধ্যাপক মহুয়া মুখোপাধ্যায় ১৯৯৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বরে। ‘‘ঝপযড়ড়ষ ড়ভ ঐরংঃড়ৎরপধষ ধহফ ঈঁষঃঁৎধষ ঝঃঁফরবং’’ শীর্ষক গৌড়ীয় নৃত্য সেমিনারে। এই বিশেষ নৃত্যটি ‘বঙ্গীয়’ কিংবা ‘বাংলার নৃত্য’ নামটি গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু তা না করে নামকরণ করা হয়েছে ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ নামে। ‘গৌড়’ কথাটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত ‘গৌড়’ শব্দটি এসেছে ‘গুড়’ শব্দ হতে যা বাংলার অতি পরিচিত মিষ্টান্ন দ্রব্য। এছাড়া বৃহৎ বঙ্গের অধিপতি রাজা শশাঙ্ককে ‘গৌরাধিশ’ বলে ভূষিত করা হয়েছিল। রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক বাংলার প্রথম ব্যাকরণ ‘গৌড়ীয় ব্যকরণ’, প্রাচীন মার্গীয় সঙ্গীতের রাগ, গৌড়কৈশিকী, গৌড়পঞ্চমা, গৌড়রাগ ইত্যাদি রূপসমূহ, মহাপ্রভু চৈতন্যদেব প্রণীত ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণধর্ম’, গৌড়বঙ্গে সাহিত্য রচনা রীতি ‘গৌড়ীয় রীতি’ অর্থাৎ যা কিছু গৌড়বঙ্গের শিল্পকলা তাই প্রাচীনকাল থেকে ‘গৌড়ীয়’ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। এরই ভিত্তিতে বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্যের নামকরণ ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

নাট্যশাস্ত্র, কলহনের রাজতরঙ্গিনী, পঞ্চম/সপ্তম শতকের তারাও মঞ্জুশ্রী ¯্রােতচর্চাপদ, দ্বাদশ শতকের ‘গীতগোবিন্দ’, ত্রয়োদশ-পঞ্চদশ শতকের পন্ডিত শুভঙ্করের ‘সঙ্গীত দামোদর’ ও ‘শ্রীহস্ত মুক্তাবলী’, পঞ্চদশকের কবি রূপগোস্বামীর ‘আনন্দ বৃন্দাবন চম্পূ’, সঙ্গীতশাস্ত্রসমূহ প্রভৃতির মাধ্যমে বিশেষ করে এই সাহিত্য ও শাস্ত্রগ্রন্থগুলো রচয়িতা ও রচনাকাল-ই প্রমাণ করে দেয় এর প্রাচীনত্ব আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্জীব শিল্পধারা হল চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য। প্রাচীনকালে বাংলার টেরাকোটা ধাতব, কাষ্ঠ, হাতির দাঁত, শোলা ও প্রস্তর নির্মিত বিবিধ নৃত্যভাস্কর্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরও উল্লেখ পাওয়া যায় ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাঙের বর্ণনাসহ ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’, ‘মার্কাও পুরাণ’ এ প্রাচীন লেখ্যমালা, শিলালিপি, তা¤্রলিপি প্রভৃতিতে। আমাদের বাংলাদেশের ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’, বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, কান্তজিউ মন্দিরে পাওয়া গেছে প্রাচীন নৃত্য-ভাস্কর্য যার সময়কাল অতি প্রাচীন। সজীবধারার মধ্যে দেবদাসী প্রথা ও লোকায়ত গুরুপরমূয়া নৃত্যধারাসমূহ নাচনী, কীর্তন, বাউল, কুশান, ওঝা, ছৌ, বউনাচ, রায়বেঁশে, ধামাইল বিভিন্ন নৃত্যধারাগুলোতে গৌড়ীয় নৃত্যের বীজ লুক্কায়িত রয়েছে। এই বিষয়গুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ যে বাংলায় শাস্ত্রীয় নৃত্য এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং চর্বিত অনেক শাস্ত্রীয় নৃত্যের থেকে এর শেকড় আরও গভীর এবং দৃঢ়ভাবে তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

আরও একটি বিশেষ প্রমাণ হল কাশ্মীরের কবি কলহন রচিত ‘রাজ তরঙ্গিনী’। এখানে কবি বলছেন, ‘কাশ্মীরের রাজা জয়াপীর যখন সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ শিক্ষার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে বাংলায় প্রবেশ করলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন কার্তিকের মন্দিরে ‘কমলা’ নাম্বী এক দেবদাসী নাট্যাশাস্ত্রানুসারে নৃত্য করছেন— তা দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন।’ এই কথা থেকে ধারণা করা হয় এই কার্তিকের মন্দিরটি বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় অবস্থিত। ‘আজি ভাল কইরা বাজাওরে ঢাকুয়া, সুন্দরী কমলা নাচে’— হয়ত এই ‘সুন্দরী কমলা’ এবং কলহনের ‘দেবদাসী কমলা’ একই ব্যক্তি। আর মূর্তির মাধ্যমে প্রাচীনবঙ্গে যে শিল্প গড়ে উঠেছিল তার একটি বড় অংশ এই বাংলাতেই রয়েছে। বিশেষত পাল ও সেনযুগের প্রস্থর খন্ডের ভাস্কর্য প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুর অঞ্চলে। বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ তাই নদী পথে প্রস্থর বহন করা সহজ হত। সেই প্রস্থর খন্ডগুলো নদী পথে এসে খোঁদাই করা হত এই বঙ্গে।