full_1725347759_1433841279

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১০ জুন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের আগেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জট খুলতে চায় ভারত। ঢাকা থেকে দিল্লি ফেরার পথে, বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিমানেই জরুরি বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।বৈঠকে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর,জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি নৃপেন্দ্র মিশ্র। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, চুক্তি সম্পন্ন করতে সম্ভাব্য উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের সঙ্গে করা ১০টি চুক্তির কাজ শুরু করার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, তিস্তা জট খুলতে কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ঘরোয়া কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ওই কমিটিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন মোদি।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোববার রাতে দিল্লি ফেরার পথে বিশেষ বিমানেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি নির্দেশ দিয়েছেন, বাংলাদেশ সফর শেষ হয়ে গেছে মানেই কাজ শেষ হয়ে গেছে এমন নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যে দশটি চুক্তি হয়েছে, তার কাজ আজ থেকেই শুরু করে দিতে হবে।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ছিটমহল বিনিময়ের কাজ জুলাইয়ের মধ্যে রূপায়িত করতে হবে। ৩১ জুলাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডে হিসেবে ধরে কাজ শুরু করা হচ্ছে। ওই চুক্তির ফলে প্রায় ৮০০ পরিবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসবে বলে অনুমান। নভেম্বরের মধ্যে সেই পরিবারগুলোর পুনর্বাসন সেরে ফেলার পাশাপাশি সীমান্তে বেড়া লাগানোর কাজ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে ভারত।স্থল সীমান্তের পাশাপাশি তিস্তা নিয়ে জট কাটানোর লক্ষ্যে তৎপর হয়েছে দিল্লি।এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ঘরোয়া কমিটি গঠন করা হচ্ছে। যেখানে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অজিত ডোভাল ও নৃপেন্দ্র মিশ্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবেন। ওই কমিটিতে সিকিম সরকারের প্রতিনিধিদের রাখার বিষয়েও ভাবা হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে ঘরোয়া স্তরে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে ভারত। উদ্দেশ্য শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগেই বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কী পেলÑএ প্রশ্ন এখন সবার মনে। বিশেষ করে অর্থনীতিবিদসহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

এতকিছু সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হলো,এর ভবিষ্যৎ বা কী? তবে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদি এসে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনিয়োগের একটি বাতাবরণ তৈরি করেছেন। যার মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতসহ ভুটান, নেপালও সুবিধা পাবে। কারণ বাংলাদেশকে নতুনভাবে ২০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেবে ভারত। এ ঋণের অর্থে অবকাঠামো, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তবে এখনো প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত হয়নি।এ ব্যাপারে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ লাভবান হবে এ কথা সত্য। তবে যে সমস্ত বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে এগুলো সম্পূর্ণ দালিলিক আকারে উপস্থাপনের পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এই দলিল যাতে দেখার সবার সুযোগ হয় সে ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আপাতত দৃষ্টিতে বাংলাদেশ তৃতীয় দেশের সঙ্গে সরাসরি ট্রানজিটের মাধ্যমে যোগাযাগ করতে পারবে।

একই সঙ্গে নৌ, স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে সুযোগ পাবে। এখানে নেপাল এবং ভুটানও মংলাবন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এটা তাদের জন্য বড় জায়গা। এর ফলে বাংলাদেশ কিছু না কিছু শুল্ক পাবে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতসহ অন্য দেশগুলো যে সুবিধা নেবে তার মাশুল কী হারে ভাগাভাগি হবে তা এখন দেখার বিষয়। তবে আমরা আশাবাদী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে বিনিয়োগের একটি বাতাবরণ সৃষ্টি হবে। ভারত সরকার যে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে এ ঋণ কোথায়, কীভাবে ব্যবহার হবে তা এখনই নিরূপণ করা দরকার। যদি ঋণের টাকায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি আমদানি উৎস হয় ভারত তাহলে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। যে কারণে আমি মনে করি আমদানি উৎস মুক্ত করে দেয়া দরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০ কোটি ডলার ঋণের বিষয় নিয়ে ভারত আগে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনা করেনি। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে কটি চমক হিসেবে উপস্থাপনার পরিকল্পনা নিয়ে ছিল দেশটির। অনানুষ্ঠানিকভাবে সেটি ভারত জানতে চেয়েছিল। গত মাসের শুরুতে বাংলাদেশ মোটাদাগে ১৫টি প্রকল্পের কথা ভারতকে জানায়। এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রেললাইন সম্প্রসারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ইঞ্জিন কোচ সংগ্রহ। এর বাইরে রয়েছে আশুগঞ্জ নদীবন্দর উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি উৎকর্ষ সাধন,৪টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু তার সুফল ভোগ করবে এ ব্যাপারে বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষক ড. জায়েদ বখত জানান, এক্ষেত্রে দুটি দেশই অর্থনৈতিকভাবে সুফল পাবে। তবে কিছু বিষয় সমঝোতা না হওয়ার অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিস্তা চুক্তি। তবে কানেকটিভিটি বাড়ালে অর্থনীতির ওপর সুফল বয়ে আসবে।সাবেক উপদেষ্টা র্মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যেসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এর ওপর নির্ভর করছে অর্থনৈতিকভাবে সফলতা অর্জন। তবে কানেকটিভিটি অনেকক্ষেত্রে শুধু ভারত নয়, পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটানের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে। তবে ২০০ কোটি ডলার ঋণ কীভাবে ব্যবহার হবে এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এর আগেও ১০০টি কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছিল। সেটি সম্পূর্ণ ব্যবহার হয়নি। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে যে সব বাধা রয়েছে, সে সব বাধা কতটুকু দূর হবে তা এখন দেখার বিষয়। অশুল্ক বাধাগুলো দূর না হলে সহজেই বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না। রফতানির ক্ষেত্রে দাফতরিকভাবে কিছু বিষয় থাকলেও, তার কোনো ব্যবহারিক ফলাফল দেখা যায় না। রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারত আমাদের কী সুবিধা দেবে তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনৈতিক সুফলের সম্ভাবনা। তবে নরেন্দ্র মোদির সফর বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রভাব পড়বেই। বর্তমানে বিনিয়োগের যে খরা চলছে তা নরেন্দ্র মোদির সফর কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে।

বিআইডিএসের আরেক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন বলেন, বিদ্যুতের মতো একটি বড় সমস্যা নরেন্দ্র মোদির সফরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তার সদিচ্ছার অভাব নেই বিনিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে। তিস্তা চুক্তি না হওয়া অর্থনৈতিকভাবে তাৎক্ষণিক না হলেও, সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। ট্রানজিটের বিনিময়ে যদি তিস্তা চুক্তি হতো তাহলে বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনার দ্বারোš§ুক্ত হতো। বাংলাদেশ থেকে যে সব পণ্য রফতানি হয় তার মধ্যে অন্যতম অশুল্ক বাধা। বাংলাদেশি পণ্য যাতে অবাধে ভারতে প্রবেশ করতে পারে তার জন্য স্টান্ডার্ড টেস্টিংয়ের জন্য স্বীকৃতি দেয়া জরুরি। কারণ সহজেই টেস্টিং ছাড়া ভারতে বাংলাদেশের কোনো পণ্য প্রবেশ করতে পারছে না। এর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ দেয়া উচিত। তাহলেই বাংলাদেশের পণ্য ভারতে ব্র্যান্ডিং হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক কমিশন হতে পারে। যে কমিশন প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়নের বিষয়টি মনিটরিং করবে।এদিকে বাংলাদেশ আমেরিকা চেম্বারের প্রেসিডেন্ট আফতাবুল ইসলাম নরেন্দ্র মোদির সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশকে বাজার সুবিধা দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশের অনেক পণ্য এখনো অশুল্ক বাধার কারণে প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশ থেকে যে পোশাক রফতানি হয় তার পরিমাণ খুবই কম অথচ সে দেশে বাংলাদেশি পোশাকের বড় ধরনের বাজার রয়েছে বলে মনে করা হয়।বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদির সফর বাংলাদেশের বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিতে পারে। এ ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ রয়েছে। তা নানাভাবে প্রকাশও পেয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনো আস্থার অভাব রয়েছে। রয়েছে অবকাঠামোর দুর্বলতা। বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তি কার্যকর করার জন্য দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের আন্তরিকতার প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এখনো যে পরিমাণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ঘাটতি রয়েছে তা ক্রমশ কমিয়ে আনা দরকার।