1440317855_34730_1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ আগস্ট: দেশের ভূমি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি ভয়াবহ দাবি করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি বলেছে, এ খাতে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদান-প্রদান হয়ে থাকে।সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ ও হস্তান্তরের অধিকার থাকলেও ভূমি সেবায় প্রতি ধাপেই অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। ভূমি সংক্রান্ত সেবা কার্যক্রমে ঘুষ লেনদেন, কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে সম্পত্তি আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব,ভোগদখলসহ এ খাতে চলছে লাগামহীন দুর্নীতি।

রোববার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রম : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবি এ তথ্য জানায়।ভূমি মালিকানার সঙ্গে জড়িত দেশের প্রতিটি মানুষই দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রমের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক।

তিনি বলেন, এর সঙ্গে দেশের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে জড়িত। আর ভূমির মালিকানার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সকলকেই প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।গবেষণা প্রতিবেদনে এ খাতে অতিমাত্রায় দুর্নীতি চলছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এমন কোনো সেবা পাওয়া যাবে না যেখানে সেবা গ্রহীতারা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয় না।ভূমি খাতে বিরাজমান ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ভূমি জরিপের সময় জরিপকর্মী কর্তৃক জমির পরিমাণ কম দেখানো ও খতিয়ানে ভুল তথ্য লেখার ভয় দেখিয়ে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ; ঘুষের বিনিময়ে খাস জমি, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত ও কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর সম্পত্তি দখলকারী ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের নামে রেকর্ড প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।

এছাড়া তহশিল অফিস কর্তৃক ঘুষের বিনিময়ে নামজারির প্যাকেজ নির্ধারণ; কোনো কোনো ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধ দখলকৃত খাসজমি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর এবং অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ক্ষমতাবান ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের নামে নামজারি; কৃষি খাস জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের প্রভাব ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি উন্নয়ন করের ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ১০,০০০ টাকা; নামজারির ক্ষেত্রে ৫ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা; রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে ১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা; এবং হাট-বাজার ইজারার ক্ষেত্রে ১০ হাজার থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদান-প্রদান হয়। তবে তা জমির ধরন ও স্থানভেদে ঘুষের পরিমাণ নির্ভর করে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি সেবার প্রতিটি পর্যায়ে সেবাগ্রহীতাদের অনিয়ম-দুর্নীতির সম্মুখীন হতে হয় এবং অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন কোনো সেবা পাওয়া যাবে না যেখানে সেবাগ্রহীতারা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হন না।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বিগত পাঁচ বছরে ভূমি খাতে সরকারের একাধিক ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ম্যানুয়াল ভূমি জরিপের পরিবর্তে ডিজিটাল ভূমি জরিপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠায় গৃহীত পাইলট প্রকল্প গহণ যার আওতায় ৭টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় মৌজা ম্যাপ, খতিয়ান ও নামজারির খতিয়ান ডিজিটাইজেশনের কাজ চলমান, খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ ডাটাবেজে সংরক্ষণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে অনলাইনে উপস্থাপন, অনলাইনে খতিয়ানের নকল উত্তোলনের আবেদন ও নামজারির আবেদন গ্রহণ এবং মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাকে নামজারির অবস্থা অবহিতকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৭৩টি ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে ৬৯ হাজার ৫৯১ একর কৃষি খাসজমি বরাদ্দ এবং চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ১৮৫টি ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার একর খাসজমি বরাদ্দ ইত্যাদি।তবে এ সকল উদ্যোগ সত্ত্বেও ভূমি খাতে এখনও সুশাসনের ব্যাপক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে।

ভূমি খাতে বিরাজমান ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি জরিপের সময় জরিপকর্মীর জমির পরিমাণ কম দেখানো ও খতিয়ানে ভুল তথ্য লেখার ভয় দেখিয়ে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া, ঘুষের বিনিময়ে খাসজমি, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত ও কোর্ট অব ওয়ার্ডসের সম্পত্তি দখলকারী ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের নামে রেকর্ড প্রস্তুত, তহশিল অফিসে ঘুষের বিনিময়ে নামজারির প্যাকেজ নির্ধারণ, কোনো কোনো ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধ দখলকৃত খাসজমি, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের এবং অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ক্ষমতাবান ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের নামে নামজারি, কৃষি খাসজমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের প্রভাব ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।প্রতিবেদনে ভূমি সেবা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘুষের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমির নামজারির ক্ষেত্রে ৩ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা, হাটবাজার ইজারায় ১০ হাজার টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা, খতিয়ান ও নকশার নকল কপি উত্তোলনে ২শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, দলিলের নকল উত্তোলনে ৮শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা, গ্রামাঞ্চলে প্রতি বিঘা ভূমি জরিপে ৫শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, শহরাঞ্চলে ৩শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা, হাটবাজারে অতিরিক্ত টোল গ্রহণের বিরুদ্ধে যেকোনো তদন্ত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিহতকরণে ১০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা, ভূমি সংক্রান্ত মামলার বিভিন্ন ধাপে ৩শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, ভূমি উন্নয়ন করে ১শ’ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা।প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিভিন্ন আদালতে ভূমি সংক্রান্ত ১৮ লাখ মামলার জট রয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় অপর্যাপ্ত জনবল ও বিভিন্ন পদে নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ টিআইবি’র এ গবেষণা প্রতিবেদনে ভূমি খাতে বিদ্যমান আইনি সীমাবদ্ধতা, ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের ঘাটতি, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রমে দুর্বল আনুভূমিক জবাবদিহিতা, ভূমি ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলি ও স্বল্পকালীন পদায়ন, মাঠ পর্যায়ের ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমি ব্যবস্থাপনার বাইরে বিবিধ দায়িত্ব পালন, সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) পেশাগত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ঘাটতি, অপর্যাপ্ত মাঠ পরিদর্শন ও পরীবিক্ষণ, মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিবেদন সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না হওয়াসহ ভূমিখাতে বিরাজমান বিবিধ সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে ভূমি খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনটি মূল সুপারিশ পেশ করা হয়। সেগুলো হল: ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভূমি সংক্রান্ত সকল প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো পরিচালনার জন্য একটি একক অধিদফতর গড়ে তোলা, ডিজিটালাইজেশনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সামগ্রিক ভূমি ব্যবস্থাপনা, রেজিস্ট্রেশন ও জরিপ ব্যবস্থায় সমন্বিত ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করা, জাতীয় বাজেটে ভূমি খাতের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ রাখা, যা ভূমি খাতের ডিজিটালাইজেশন কর্মকাণ্ড, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় ও দৈনন্দিন অফিস ব্যবহারের জন্য ব্যয়িত হবে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ভূমি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আমাদের দেশে ভূমি বিরোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, আদালতে মামলার জট সৃষ্টি হচ্ছে। ভূমি জরিপ, নামজারি, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, নথিপত্র উত্তোলনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশের কারণে প্রকৃত ভূমি মালিকরা আর্থিক ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে জনবল, অবকাঠামো, লজিস্টিকস, প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের ঘাটতি রয়েছে। ফলে সুষ্ঠু ভূমি ব্যবস্থাপনা ব্যহত হচ্ছে এবং সেবা গ্রহীতাদের জনবান্ধব সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের জুলাই মেয়াদে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়।টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম, ডেপুটি গ্রোগ্রাম ম্যানেজার নিহার রঞ্জন রায় এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা গবেষণার সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।