পৌর নির্বাচনঅস্ত্র জমার নির্দেশনা নেই, জনমনে আতংক ও শঙ্কা

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫: স্থানীয় সরকারের পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে লাইসেন্সধারীদের অস্ত্র জমা না নেয়ায় কিংবা এ সংক্রান্ত কোন নির্দেশনা না দেয়ায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমনকি যেসব এলাকায় লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিক কিংবা বৈধ অস্ত্রধারীদের আত্মীয় স্বজন প্রার্থী হয়েছেন সেসব পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরাও আসন্ন নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের আশঙ্কা করছেন। এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষ্যে অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কোন কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা শুরু করেছেন। তারা আগের চেয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্রের যত্রতত্র ব্যবহারের আশঙ্কায় জনমনে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছে। এদিকে, পৌর নির্বাচনে আচরণবিধি তদারকিতে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একজন করে নির্বাহী হাকিম নামছেন রোববার থেকে। সেই সঙ্গে ভোটের আগে-পরে চার দিন আরও এক হাজার নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম দায়িত্বে থাকবেন।নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান,পৌর ভোটে মোট ৯৭০ জন নির্বাহী হাকিম এবং ২৩৪ জন বিচারিক হাকিম দায়িত্ব পালন করবেন। গত বুধবার কমিশন সভায় ২৩৪ পৌরসভায় হাকিম নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার প্রায় ১২শ’ নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এবং হাই কোর্ট বিভাগের পরামর্শ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন ইসির আইন শাখার উপ সচিব মহসিনুল হক।ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১৩ ডিসেম্বর থেকে প্রতি পৌরসভায় একজন করে একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। প্রতীক বরাদ্দের পর ১৪ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে। আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবেন তারা। এ নির্বাচনে মেয়র পদে সহস্রাধিক এবং কাউন্সিলর পদে প্রায় ১২ হাজার প্রার্থীকে বৈধ ঘোষণা করেছে ইসি। ১৩ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সংখ্যা চূড়ান্ত হবে।ইতোমধ্যে অনেক এলাকায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে সতর্ক করে ভোটে থাকা ২০টি দলকে চিঠিও দিয়েছে ইসি। পথসভা ও ঘরোয়া সভার বাইরে জনসভা, শোভাযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইসি বলেছে, ১৪ ডিসেম্বর থেকে কঠোর অবস্থান থাকবে তাদের।ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপ-সচিব সামসুল আলম জানান, পৌরসভা নির্বাচনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কাযক্রম পরিচালানায় প্রতিটি পৌরসভার জন্য ২৩৪ জন হাকিম প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৩ ডিসেম্বর থেকে ভোটের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাঠে থাকবেন।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের নেতৃত্ব দেবেন নির্বাহী হাকিম। নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন তারা। পৌর এলাকায় নির্বাচনী অপরাধ আমলে নিতে প্রতি পৌরসভায় একজন করে এবং আঠারোর বেশি ওয়ার্ডের পৌরসভায় দুইজন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হবে। ফলে ২৩৪ পৌরসভায় ২৩৯ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ পাবেন।এ সময় প্রতিটি পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে ৭৩০ জন নির্বাহী হাকিম আচরণবিধি সংক্রান্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য থাকবেন।

ইসির আইন শাখার কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের অপরাধে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত এবং আচরণবিধি লংঘনের দায়ে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।বিচারিক হাকিম নির্বাচনী অপরাধ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সাজা দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন। অন্যদিকে নির্বাহী হাকিম ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সাজা দিতে পারেন। এর সঙ্গে অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে।বিধি লঙ্ঘনের দায়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও ইসির রয়েছে।

এদিকে , আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতে যেমন অবৈধ অস্ত্র রয়েছে, তেমনিভাবে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারও বেড়েছে। আবার ১০ হাজারের বেশি বৈধ অস্ত্রের হদিস পাচ্ছে না সরকার। এ অবস্থায় ৩০ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা নেয়ার ঘোষণা আসেনি এখনো। বলা হচ্ছে- অস্ত্র জমা নয়, লাইসেন্সধারীদের নজরদারি করা হবে। ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে।সংশ্লিষ্ট জানা গেছে, গত ৫৫ বছরে বৈধ লাইসেন্সের বিপরীতে কেনা অস্ত্রের সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই কারো কাছে। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অস্ত্রের লাইসেন্স সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। মোট লাইসেন্সের মধ্যে অস্ত্র কেনা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার। অবশিষ্ট ৯০ হাজার লাইসেন্সের বিপরীতে কোনো ধরনের অস্ত্র কেনা হয়নি। এক লাখ ১০ হাজার লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজারের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনের ঠিক আগে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় দ্বিতীয় দফায় আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয়ার নোটিশ দেয়া হয়। দুই দফাতেই সর্বোচ্চ ৭০ হাজার অস্ত্র জমা পড়ে। অস্ত্র জমা না দেয়া, লাইসেন্স নবায়ন না করা, অস্ত্রের মালিক খুঁজে না পাওয়া এবং লাইসেন্সের যাবতীয় শর্ত পূরণ না করে অস্ত্র নেয়ায় সরকার মোট ২৫ হাজার লাইসেন্স বাতিল করে। বাতিল করার আগে একই কারণে আরো চার হাজার বৈধ অস্ত্র সরকার জব্দ করে। এর পাশাপাশি পাঁচ শতাধিক লাইসেন্সধারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় অস্ত্র আইনে মামলা।

অস্ত্রের প্রকৃত হিসাব বের করতে সরকার এ পর্যন্ত ১০১টি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিগুলো বৈধ অস্ত্রের গরমিলের জন্য প্রধান তিনটি কারণ চিহ্নিত করে। এগুলো হচ্ছে- অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন না করা সত্ত্বেও বছরের পর বছর লাইসেন্সধারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া, লাইসেন্স প্রদানকারী জেলা কর্তৃপক্ষের দপ্তরে নবায়ন না করে অন্য জেলায় নবায়ন করা, স্বাধীনতার পর অবাঙালিদের নামে দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল না করা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্যবহৃত বেহাত হওয়া বৈধ অস্ত্রের তালিকা তৈরি না করা।অন্যদিকে, বাতিলকৃত ২৫ হাজার লাইসেন্সের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) দেয়া প্রায় দুই হাজার লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্সের যাবতীয় শর্ত পূরণ না করে অস্ত্র নেয়ায় জোট সরকার এসব লাইসেন্স বাতিল করে। আওয়ামী লীগ আমলে মোট ১৯ হাজার ১২৫টি অস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যূ করা হয়। এর মধ্যে মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ তাদের আত্মীয়দের নামে লাইসেন্স ইস্যূ করায় অভিযোগ রয়েছে।

১৯৭২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৬৪টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেয় সরকার। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর মধ্যে সব বৈধ অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন সব অস্ত্র বিক্রেতার (আর্মস ডিলার) গুদাম সিল করে দেয়া হয় এবং আলাদা করে শ্যুটিং ক্লাবগুলোকে অস্ত্রের হিসাব দিতে বলা হলেও হিসাব মেলেনি। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেলাগুলোতে অস্ত্রের হিসাব দিতে রুটিন মাফিক চিঠিপত্র দেয়া অব্যাহত রেখেছে।এদিকে নবায়ন না করার জন্য এবং সরকার- ঘোষিত নির্ধারিত সময়ের পরে জমা দেয়ার কারণে যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার অস্ত্র আবার মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ২০০৫ সালের ২৪ মার্চ চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।২০০৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্ধারিত সময়ে জমা না দেয়া এবং নবায়ন না করা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করে তা জব্দ করতে নির্দেশ জারি করে। জমা পড়া অস্ত্রের সঙ্গে বিতরণ করা লাইসেন্সের হিসাব মেলাতে তখন ১০২টি ম্যাজিস্ট্রেট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি জেলায় জেলায় অস্ত্রের লাইসেন্স-সংক্রান্ত রেকর্ড পর্যালোচনা করে কূলকিনারা করতে পারেনি। তবে ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তারা প্রায় ৮ হাজার লাইসেন্স বাতিল করার সুপারিশ করে। অনেক জেলায় রেকর্ডপত্র না পাওয়ায় কতজনকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।অন্যদিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে অস্ত্রধারীদের কদর বেড়েছে। তারা নির্বাচনী এলাকায় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে মিশে আছে। প্রার্থী বা স্বজনদের বৈধ অস্ত্র রয়েছে এমন ব্যক্তিরা প্রতিপক্ষকে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ইসিতে একাধিক অভিযোগ পড়ছে বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে।

প্রসঙ্গত, এবারের পৌরসভা নির্বাচনে সাড়ে তিন হাজার কেন্দ্রে ভোট হবে। এতে পুরুষ ভোটার ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৬ জন এবং নারী ভোটার ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪০ জন।৩০ ডিসেম্বর এসব পৌরসভায় মেয়র পদে ২৩৪ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৭৩৮ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২ হাজার ৯৫২ জনকে নির্বাচিত করবেন ভোটাররা। ভোট গ্রহণ করবেন ৬১ হাজার ১৪৩ জন কর্মকর্তা।