maxresdefault

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬: মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত বাংলাদেশসহ সাতটি দেশের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সে দেশের শিশুদের যৌন নির্যাতন করেছেন। ২০১৪ সালে সংঘটিত এই অপরাধের বিষয়টি কয়েক সপ্তাহ আগে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে।নিউইয়র্কে শুক্রবার জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এক আবেগঘন সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশ করেন এই সংস্থার অন্যতম সহকারী মহাসচিব এন্থনি ব্যানবারি। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে শিশুদের যৌন নিপীড়নে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীও অভিযোগের মুখে রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এসেছে।জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব (ফিল্ড সাপোর্ট)অ্যান্থনি ব্যানবারি শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে যে নতুন অভিযোগগুলো তুলে ধরেন, তাতে বাংলাদেশি সৈন্যদের সংশ্লিষ্টতার কথাও রয়েছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

মধ্য আফ্রিকার দেশটিতে মুসলিম-খ্রিস্টান সংঘাত থামাতে ২০১৩ সাল থেকে বিদেশি সৈন্য রয়েছে। প্রথমে যায় ফ্রান্সের সৈন্যরা। পরের বছর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীও মোতায়েন করা হয় দেশটিতে। সেখানে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি সৈন্য কাজ রয়েছে।২০১৫ সালে এই দেশটিতে বিদেশি সৈন্যদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। সংবাদ সম্মেলনে নতুন ১২টি অভিযোগ তুলে ধরেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব, যা নিয়ে ঘটনার সংখ্যা বেড়ে ২২টি হল।ছয়টি শিশু অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশ, কঙ্গো, নাইজার, মরক্কো ও সেনেগালের শান্তিরক্ষীদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা।ছয়টি শিশুর অভিযোগ ফ্রান্স, জর্জিয়া ও আরেকটি ইউরোপীয় দেশের সৈন্যদের দিকে।শিশুদের অভিযোগ অনুযায়ী, ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৪ সালে দেশটির রাজধানী বাঙ্গির বিমানবন্দরের পাশের একটি শরণার্থী শিবিরের কাছে।

বিবিসি জানিয়েছে, এই শিশুদের কয়েকজন (১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী) অভিযোগ করেছে যে জর্জিয়ার সৈন্যরা তাদের ধর্ষণ করেছে। ফরাসি সৈন্য দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন সাত বছর বয়সী একটি মেয়ে এবং নয় বছর বয়সী একটি ছেলে।তবে কতটি ঘটনায় বাংলাদেশি কতজন সৈন্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এসেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।এই অভিযোগ ওঠার পর গত মাসে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের যৌন নির্যাতনে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছিল। এখন জাতিসংঘও তা স্বীকার করল।

শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ দেশ তদন্ত শুরু করেছে বলে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে। নাইজার ও সেনেগালের সৈন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জাতিসংঘই তদন্ত করছে।নিউ ইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনে অ্যান্থনি ব্যানবারি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, যারা জাতিসংঘের হয়ে শান্তি রক্ষার কাজ করে, যারা নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করে; এই ধরনের অভিযোগ তাদের কতটা ক্ষুব্ধ করেছে, তা বলে বোঝানোর নয়।নির্যাতিতদের জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব কিছু করার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, এর বিচার হবে যাতে ভবিষ্যতে আর এমন ঘটনা না ঘটে।শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার মুখপাত্র রুপার্ট কলভিল জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, এটা কীভাবে বিস্তৃত হচ্ছে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ঘটনাই তা মেলে ধরেছে।শান্তিরক্ষীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন, তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তারপরও এই বাহিনীর কিছু সদস্যের এই ধরনের অপকর্ম আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। যৌন নির্যাতনের শিকার বিভিন্ন শিশুর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্ত শেষে জাতিসংঘ এই তথ্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ছাড়া অভিযুক্ত অন্য দেশগুলো হলো ফ্রান্স, জর্জিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো,নাইজার, সেনেগাল এবং অন্য আরেকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ।উল্লেখ্য, গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার এই দেশটিতে শান্তি রক্ষায় সহায়তা দিতে ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৭০০ সেনা মোতায়েন করা হয়। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করলে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব ইইউর হাত থেকে জাতিসংঘের হাতে হস্তান্তর করা হয়। সেনা ও পুলিশসহ জাতিসংঘের এই মিশনে মোতায়েন করা শান্তিরক্ষীর সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। ৫০টিরও বেশি দেশের সেনা ও পুলিশের সদস্য এই বাহিনীতে রয়েছেন।শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এন্থনি ব্যানবারি। তিনি বলেন, জাতিসংঘের জন্য শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন, তা ভাবা যায় না। তিনি আশ্বাস দেন, ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করা হবে। দায়বদ্ধতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। জানা গেছে, নির্যাতিত শিশুদের মধ্যে বালক ও বালিকা রয়েছে, যাদের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।

এদিকে জেনেভায় এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দায়বদ্ধতার অভাব ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থতার কারণেই বারবার এমন ঘটনা ঘটে চলেছে বলে তিনি জানান। বেশ কিছুদিন থেকেই মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষী সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের কথা শোনা গেলেও এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে অপরাধী সদস্যদের দেশের নাম প্রকাশ করলেন।অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলার পর গত বছর আগস্টে মহাসচিব বান কি-মুন সেখানে জাতিসংঘ মিশনের প্রধান বাবাকার গাইয়ে-কে বরখাস্ত করেন।উল্লেখ্য, জাতিসংঘের নিয়ম অনুসারে, অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত শান্তিরক্ষী সেনা বা পুলিশ সদস্যকে যাঁর যাঁর দেশে বিচারের সম্মুখীন করার নিয়ম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই শান্তিরক্ষী পাঠানো দেশগুলো যথাযথ বিচারের বদলে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে থাকে।জাতিসংঘ সদর দপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা হলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি।