মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধী নেত্রকোনার রাজাকার মো.ওবায়দুল হক ওরফে আবু তাহের ও আতাউর রহমান ননীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ের ৪৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ কথা বলেছেন।ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, পাক দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে বাঙালি জাতি ও মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। এটি ঐতিহাসিক সত্য। যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। লাখ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস নিঃসন্দেহে জাতির পবিত্র আবেগ ও মুক্তিযুদ্ধের অহংকারের সঙ্গে মিশে আছে।বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। তাঁর এই বক্তব্যের পর এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁর পর্যবেক্ষণে এ কথা বললেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপিনেত্রীর বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছে, এ বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।মঙ্গলবার নেত্রকোণার রাজাকার মো. ওবায়দুল হক ওরফে আবু তাহের ও আতাউর রহমান ননীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই বক্তব্য আসে বলে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জানান।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ত্রিশ লাখ শহীদের বিষয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, রায়ে সেই যুক্তি খণ্ডন করে দৃঢ়তার সঙ্গে আদালত বলেছেন, ত্রিশ লাখ শহীদ নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কের অবকাশ নাই। এই ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদানেই স্বাধীন বাংলাদেশ।বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে, তাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে দুই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে।গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীতে একটি আলোচনা সভায় খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, আজকে বলা হয় এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কত লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানা রকম তথ্য আছে।ওই বক্তব্যে দেশদ্রোহী’ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে অভিযোগ করে আদালতে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। ওই বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ঢাকার একটি আদালত বিএনপি চেয়ারপারসনকে তলবও করেছে।

অবশ্য বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোন্দকার মাহবুব হোসেনের দাবি, খালেদার ওই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের সংজ্ঞায় পড়ে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনের দিকটি খতিয়ে না দেখে আবেগের বশে মামলার অনুমোদন দিয়েছে।এটি ভুল ধারণার ওপর করা হয়েছেৃএবং সরকারও আবেগের বশবর্তী হয়ে এই মামলা করার অনুমতি দিয়েছেন আইনের বিধান মোতাবেক। এটি সঠিক হয় নাই।মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন দলের অন্য নেতারাও।খালেদার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে জরিপ করে সঠিক সংখ্যা নিরূপণের দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। আর নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে সঠিক সংখ্যা নিয়ে তালিকা করবেন।অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছেন, খালেদা জিয়ার পাকিস্তানপন্থি মনোভাবই’ তার ওই মন্তব্যের কারণ।শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় থাকলে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কীভাবে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বাণীতে ‘৩০ লাখ’ সংখ্যাটি উল্লেখ করেছিলেন, সে প্রশ্নও ইতোমধ্যে উঠেছে।ওই বক্তব্যে দেশদ্রোহী’ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে অভিযোগ করে আদালতে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। ওই বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ঢাকার একটি আদালত বিএনপি চেয়ারপারসনকে তলবও করেছে। প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে ত্রিশ লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন, সেটি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এ ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে কোনো ধরনের বির্তকের কোনোই অবকাশ নেই বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।মঙ্গলবার নেত্রকোনার রাজাকার কমান্ডার মো. ওবায়দুল হক তাহের ও তার সহযোগী রাজাকার আতাউর রহমান ননীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দেন ট্রাইব্যুনাল।

২৬৮ পৃষ্ঠার রায়ে তাহের ও ননীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার-উল হকের নেতৃত্বে বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, দেশান্তরিতকরণ, বাড়িঘরে আগুন ও লুটপাটের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে চারটি প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ এ সাজা দেওয়া হয়েছে।রায়ের ২৫২ পৃষ্ঠার ৪৪৬ অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল বলেন, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে বাঙালি জাতি ও মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস ধরে যে যুদ্ধ করেছে, তা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, লাখ লাখ নারী তার সর্বোচ্চ সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন, প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন, লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস নিঃসন্দেহে জাতির পবিত্র আবেগ ও মুক্তিযুদ্ধের অহঙ্কারের সঙ্গে মিশে আছে। তাহের-ননীর রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, ‘ইতোমধ্যে ৩০ লাখ শহীদের বিষয়ে যে বির্তকের সৃষ্টি হয়েছে এ রায় প্রদান করার মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল যে বিষয়ে সে যুক্তিখণ্ডন করেছেন। ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে কোনো ধরনের বির্তকের কোনোই অবকাশ নেই। এবং এ ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে এ রায়ের মধ্যে দিয়ে। শহীদ পরিবার এবং ভিকটিম পরিবার, তাদের যে সন্তুষ্টির এবং আকুতির বিষয় রায় প্রদানের মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।